‘নেভানোর এখন আর সময় নেই, আগুন এতক্ষণে পিপে ছুঁয়েছে,’-এই বলে হাতের মশাল ফেলে দিয়ে, মর্ডন্ট সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিল। আর
অপার্থিব আওয়াজে, তারপরই আগুনের হলকা আকাশ ভেদ করে। গ্ৰসলো আর তার নাবিকেরা জলে ঝাঁপ দেবারও সময় পেল না।
সেই ভয়ানক দৃশ্যের দিকে তাকিযে সবই ভুলে গেল নৌকায় বসা পলাতকরা হত্যাকারীরা নিজেদের ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু এ যে বড় মর্মান্তিক মৃত্যু। ওরা ঈশ্বরকে স্মরণ করারও সময় পেল না।
কিন্তু বেশিক্ষণ ওদের চিন্তা করবে—দ্যার্তেগারাও তেমন নিরাপদ নয়। ওদের জীবন শেষ হয়েছে আগুনে। এদেরও যে কোনো মুহূর্তে জীবন্ত ডুবে মৃত্যু হতে পারে। দিকচিহ্নহীন অন্ধকার সমুদ্র। জাহাজ ডুবির ঢেউ-এর আঘাতে উথাল পাথাল ছোট নৌকা। তাতে আশ্রয় নিয়ে এই সাতটি মানুষ আর কতখানি নিশ্চিন্ত হতে পারে। নৌকা চলে যায়। হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার সেই সমুদ্রের বুক চিরে ‘বাচাও বাঁচাও। কে ডাকে? এ নিশ্চয়ই সেই মর্ডন্ট। কণ্ঠস্বর ভুল হওয়ার কথা নয়।’
‘ও তাহলে মরেনি’–বলে দ্যার্তেগা। দ্বিগুণ জোরে দাঁড় টানে গ্রিমড।
‘কাউন্ট দ্যা লা ফেয়ার। উদার, মহানুভব কাউন্ট। আমায় বাঁচান।’ আকুল আহ্বান ভেসে আসে আবার। বিশেষ করে অ্যাথোসকে সম্বোধন করেই বার বার আবেদন জানায় ধূর্ত। অ্যাথোসের হৃদয় যে কতখানি কোমল তার জানতে বাকি নেই।
সত্যিই অ্যাথোসের মনে দাগ কাটে এই আর্ত আবেদন, স্পষ্টই দেখা যায় অ্যাথোস চঞ্চল হয়ে উঠছে।
মর্ডন্ট আবারও চিৎকার করে উঠে আমাকে কি সত্যি মারতে চাচ্ছেন কাউন্ট। ভেবে দেখুন, বয়সে কত তরুণ আমি। আপনার যদি পুত্র থাকে, তবে তার বয়স হয়ত আমার মতো হবে। মনে করুণ, আপনার সেই পুত্রই জীবন ভিক্ষা চাইছে আপনার কাছে।
আর সহ্য করতে পারে না দয়ালু অ্যাথোস। চিৎকার করে ডেকে বলে ‘তুমি একটু চেষ্টা করে এদিকে ভেসে আস, আমরা তোমায় নৌকায় তুলে নেব।’
‘অ্যাথোস বলে কী?’ এক সঙ্গে তিন বন্ধু চমকে উঠল।
অ্যাথোস অনুরোধ করে বলে, একটি বালক মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে তোমাদের কাছে আশ্রয় চাইছে, কি বলে তোমরা তাকে ফিরিয়ে দেবে?
তীক্ষ্ণ স্বরে দ্যার্তেগা বলে–‘বালক? এই বালক তোমার চোখের সামনে গুলি করে লর্ড উইন্টারকে মেরেছে। এই বালকই মুখোশের আড়ালে আত্মগোপন করে রাজহত্যা পর্যন্ত করেছে। এরই মধ্যে তা ভুলে গেছ তুমি?’
পোর্থস তরোয়াল খুলে উঁচু করে তুলে ধরে—’সে এসে যদি নৌকা স্পর্শ করে, তার হাত আমি কেটে ফেলব।’
কিন্তু মর্ডন্ট যখন সত্যসত্যই এসে নৌকা ধরল তখন তরোয়াল হাকাতে পারল না পোর্থস। তাকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল অ্যাথোস—’এই যে আমার হাত ধর তুমি। তারপর আমার কাঁধ ধরে নৌকায় উঠে পড়।’
একটু ঝুঁকে পড়ে নৌকা থেকে নিজের কাধ বড়িয়ে দিল অ্যাথোস। মর্ডন্ট এসে জাপটে ধরল সেই কাধ। কেমন করে অ্যাথোসকে বাধা দেবে তা পোর্থস বা অন্য কেউ ভেবে পেল না।
কিন্তু হঠাৎ একটা পিশাচের হাসিতে সমুদ্র আকাশ শিউরে উঠল। সে হাসি মর্ডন্টের–‘মাগো মা। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার চার শত্রুকেই শেষ করে শাস্তি দেব তোমার আত্মাকে। তা আর হলো না। তবু একজনকে শেষ করছি। নাও তাকে। চারজনের মধ্যে যে ছিল সেরা শত্রু তোমার। তাকেই উৎসর্গ করছি তোমার কাছে।’
নৌকার কিনারে ঝুঁকে পড়েছিল অ্যাথোস। প্রবল শক্তিতে তাকে জলে ফেলে দিল মর্ডন্ট। অ্যাথোস এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। ছিল না অন্য কেউ, চোখের সামনে সমুদ্রজলে অ্যাথোস মিলিয়ে গেল। তারা কেউ কিছুই করতে পারল না।
অ্যাথোস ডুবেছে, মর্ডন্ট ডুবেছে, জলে ঢেউ উঠেছিল, ঢেউ থেমে গিয়ে বুদ্বুদ উঠেছিল, এখন সব শান্ত। কালো জলের দিকে ছয়জোড়া চোখ পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। তারা কেউ ভাবতে পারেনি, অ্যাথোসকে এভাবে ছেড়ে যেতে হবে।
প্রায় দুই মিনিট। তারপর হঠাৎ আবার জলে বুদ্বুদ দেখা গেল, ছোট একটা ঢেউ উঠল, তারপর জলের উপর ভেসে উঠল একটা মাথা। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল ছয়টা কণ্ঠ—’ছয়জোড়া হাত ধরাধরি করে নৌকায় তুলে ফেলল অ্যাথোসকে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নৌকার পাশে ভেসে উঠল মর্ডন্টের দেহটা। অ্যাথোসের ছোরা তার বুকে গাঁধা। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, অ্যাথোস, ঈশ্বর আমায় ক্ষমা করুন। আমার ছেলে আছে, তার কথা মনে করেই ওকে আমি হত্যা করতে বাধ্য হয়েছি।’
.
৯.
অ্যাথোসের জ্ঞান নেই, এমন কোনো জিনিস পৃথিবীতে কমই আছে। নৌবিদ্যাও তার ভালোই জানা ছিল এক সময়ে, নাবিকের শিক্ষাই সে পেয়েছিল তরুণ বয়সে।
সে শিক্ষার সাহায্যে নৌকাটিকে সে নিরাপতে ভাসিয়ে রাখল এবং ক্রমশ ফরাসি উপকূলের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল, অন্য সবাই সারা দিনরাত্রি চরম উত্তেজনার পর নৌকার খোলের ভেতর শুয়ে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেক বেলায় তারা উঠল অনেক ক্ষুধা নিয়ে। ওদের ভাগ্য ভালো কিছু খাবার এবং পানীয় গ্ৰসলো মজুদ রেখেছিল নৌকায়। সেগুলি ব্যবহার করে শরীরকে তাজা করে তুলল।
অবশেষে একটা জাহাজ পাওয়া গেল। সেটা বোলো বন্দরে যাচ্ছে। মাথাপিছু এক স্বর্ণমুদ্রা ভাড়া দিয়ে, ওরা সেই জাহাজে উঠে পড়ল। বিকেলবেলা বোলো বন্দরে নামল।
নেমেই পোর্থস কোনো ভালো হোটেলে যেতে চাইছিল। দ্যার্তেগা তাতে বাধা দিল। বন্দরের ডানদিকে সমুদ্র পারে ঝাপির সারিতে ভর্তি, ও সবাইকে সেদিকে টেনে নিয়ে চলল। বন্দর থেকে কিছু খাবার কিনেও নিল।