.
লাইনিং বিদ্যুৎ জাহাজের নাম। ক্যাপ্টেন রিচার্ডস। অ্যাথোসের কথা হয়েছিল এই রিচার্ডস এর সঙ্গেই।
কিন্তু রিচার্ডস তখন জাহাজে নেই। অ্যাথোস যখন তার বন্ধুদের নিয়ে এসে সমুদ্রকূলে পৌঁছল তখন। অসুস্থ হয়ে সে নিজের বাড়ি চলে গিয়েছে। তার বদলে যে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে, তাকে রাতের অন্ধকারে চিনতে পারল অ্যাথোসেরা, এই সেই গ্ৰসলো। তাকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে সৈন্যদের দায়িত্বশীল পদ থেকে, কর্তব্যে অবহেলার জন্য, সে ভার পেয়েছে আপাতত রিচার্ডস এর জায়গায় জাহাজ চালাবার জন্য। যদি এ কাজটি ভালয় ভালয় করে দিতে পারে, তাহলে আবার পুরনো পদে ফিরে যেতে পারবে, এমনি একটা ক্ষীণ আশ্বাস সে পেয়েছে।
অ্যাথোসদের প্রথমে রিচার্ডস নেই দেখে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু তখন তাদের সঙ্গীন অবস্থা, বেশি সতর্ক হওয়ার সুযোগ নাই, জাহাজ রয়েছে, জাহারে ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এখনই জাহাজ নিয়ে রওনা হতে প্রস্তুত। এটাই কি তাদের পক্ষে বেশি নয়?
তর্ক না করে চার বন্ধু আর তিন চাকর জাহাজে বসল। প্যারীর ভাই ঘোড়াগুলোকে লন্ডনের পথে ফিরিয়ে নিয়ে চলল। তখুনি জাহাজ ছেড়ে দিল।
রাত গভীর। অ্যাথোসদের উপরের ডেক সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে তারা গভীর ঘুমে অচেতন। নিচের তলায় গ্রিমড, ম্যাস্কেটন আর ব্লেইগিয়স ঘুমের তোড়জোড় করছে। কিন্তু অসুবিধা হয়েছে একটা। বিলাসী পোর্থসের মতোই বিলাসী চাকর মাস্কেটন। একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে তার দীর্ঘদিন ধরে, রাতে ঘুমের আগে এক গ্লাস সুস্বাদু মদ খেতে না পারলে ঘুম আসে না। তাড়াতাড়ি লন্ডন থেকে আসার সময় মদ সে সঙ্গে করে আনতে আছে। গ্রিমড বলল।
গ্রিমড সেরকমই শুনেছে, জাহাজে উঠেই দ্যার্তেগা একবার উপর নীচ সব পরীক্ষা করে দেখেছিল। খোলর ভেতর পাঁচটা পিপাও দেখেছিল। জিজ্ঞাসা করাতে পিপেগুলোতে পোর্ট মদ আছে বলে জানিয়েছিল ছদ্মবেশী গ্রসলো।
এই খবরটাই মাস্কেটনকে জানিয়ে দিল গ্রিমড, আহা এক গ্লাস মদের অভাবে ঘুম আসছে না বন্ধুর? যাক না, নিয়ে আসুক গিয়ে। সত্যিই মাস্কেটন পোর্ট আনতে গেল, এক গ্লাস নয়, এক মগ আনবে। একা সে পেটি খাবে না। সে স্বার্থপর নয়। সে এক গ্লাস গ্রিমডকে দেবে, ব্রেইসিয়মকেও দেবে এক গ্লাস।
মগ ভর্তি করে খানিক পরেই সে ছুটে এল। উত্তেজনায় তার চোখ দুটো বেরিয়ে যেতে চাইছে। এটা কি জাতীয় পোর্ট হে গ্রিমড? গ্রিমডের সামনে মগ রেখে সে জিজ্ঞেস করল।
গ্রিমড অবাক হয়ে দেখল, তরল সোনার রং এর বদলে কালো এক রকম গুড়ো পদার্থে মগ ভর্তি রয়েছে। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে সে লাফিয়ে উঠল-এতো বারুদ! সব কয়টা পিপেই এই দিয়ে ভর্তি নাকি?
‘সব কয়টাই।’
গ্রিমড মগ হাতে নিয়ে ছুটল কর্তাদের কাছে। জানাল দ্যার্তেগাকে। দ্যার্তেগা নিজের চোখে একবার পরীক্ষা করে এলো পিপেগুলো। তারপর বন্ধুদের জানিয়ে বলল—’এই মুহূর্তে জাহাজ ছাড়তে হবে। মর্ডন্ট বা ক্রমওয়েল যেই হোক আমাদেরকে জাহাজ সুদ্ধ উড়িয়ে দেবার মতলব করছে।’
তারা নৌকা নামাতে গেল চুপি চুপি। যাতে নাবিক বা ক্যাপ্টেন টের না পায়। এদিকে নিজেদের ব্যবহার করার জন্য গ্রসরো নৌকা জলে নামিয়ে রেখেছে। জানা নেই, কতক্ষণ বা কয়দিন নৌকায় থাকতে হবে। সেই জন্য। কিছু খাঁচার এবং কয়েক বোতল পানীয়ও সে সাবধানে নৌকায় গুছিয়ে রেখেছে।
মর্ডন্ট ঠিক রাত বারোটার সময় জাহাজে আগুন দেয়ার কথা। সে ক্যাপ্টেনের কেবিনে লুকিয়ে আছে। সে এবং এসলো নিজের বিছানায় নাবিকদের জানায়নি নৌকা নামাবার আসল উদ্দেশ্য। কড়া নিষেধ আছে মর্ডন্টের।
জলে নৌকা ভাসছে। জাহাজের সঙ্গে রশি দিয়ে বাধা, চাকরদের নিয়ে চার বন্ধু সাবধানে উঠে বসল নৌকায়। তারপর রশি কেটে দিয়ে জাহাজ থেকে অনেক দূরে চলে গেল, নৌকা বেয়ে বেয়ে। মর্ডন্ট ঠিক বারোটায় গ্রসলোকে বলল–‘আমি বারুদের পিপের গায়ে পলতে বেধে রেখে এসেছি, দ্বিতীয় মুখ এই সেই পলতের। এখানে আমি এখন আগুন লাগিয়ে দিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পলতে জ্বলতে জ্বলতে পিপের গায়ে পৌঁছাবে। আমি আসছি। নাবিকদের এর মধ্যে তুমি নৌকায় তোলা। ফরাসিগুলোকে একঘরে তালা বন্ধ রেখে আসছি। যাতে কেউ জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারে।’
‘চটপট নৌকায় উঠে পড়ো’–গ্ৰসলো নাবিকদের আদেশ দিলেন। আশ্চর্য। নাকিবেরা রশি ধরে টানতেই রশি সড়সড় করে উপরে উঠে এল।
‘নৌকা কোথায় রশির মাথায়?’
‘নৌকা তো নেই, ক্যাপ্টেন।’
নৌকা নেই? মাথার চুল সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল গ্রসলোর। পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল সে। নৌকা নেই, নিশ্চয়ই নৌকা চুরি করে পালিয়েছে ফরাসিরা। সে মর্ডন্টের কাছে পাগলের মতো ছুটল। সে যাতে পলতের মুখে আগুন না দেয়, বা দিয়ে থাকলেও এক্ষুণি নিভিয়ে ফেলে। মর্ডন্টের সাথে মাথা ঠোকাঠুকি লাগল দুপা না যেতেই। জ্বলন্ত একটা মশাল তার হাতে। এই মশাল দিয়ে সে পাঁচ মিনিট আগে পলতের মুখে আগুন জ্বালিয়েছে। তারপর ফরাসিদের ঘরের বাইরে একটা তালা ঝুলিয়ে–
ভূতে ধরা মূর্তি গ্রসলোর–‘নৌকা নেই, আগুন নেবাও।’
‘নৌকা নেই’–আর্তনাদ করে উঠল মর্ডন্ট।
পাল্টা আর্তনাদ গ্রসলোর–‘না, এক্ষুণি আগুন নেবাও।’