‘আমরা শুনেছি বোফর্টের সঙ্গে মাত্র চার জন সঙ্গী আছে।’
‘কিন্তু এত অনেক ঘোড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।’ বলে পোর্থ।
‘চার হোক আর চল্লিশ হোক–ধরব বলে বেরিয়েছি যখন, তখন ধরবই। বোফর্টকে দ্যার্তেগার ওয়াদা মিথ্যে হবে না। আরো জোরে ঘোড়া ছোটাল দ্যার্তেগা। রাজপথে ঘোর অন্ধকার। অন্ধকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এল দুটো জমাট অন্ধকারের স্তূপ। সেই স্তূপ থেকে কর্কশ আওয়াজ এল-’ কে যায়, থামো।
‘যে যার সে রাজার নামে যায়। সরে যাও, নতুবা মরো।’ হুংকার দিয়ে উঠে দ্যার্তেগা।
পরমুহূর্তেই এদিকে দ্যার্তেগা আর পোর্থস, অন্যদিকে সেই দুই জমাট কালো মূর্তির মধ্যে শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ।
পোর্থসের তরোয়ালের আঘাতে তার প্রতিপক্ষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দ্যার্তেগার পিস্তলের গুলিতে ঢলে পড়ল দ্বিতীয় জন।
‘চলো চলো’ বলে ঘোড়া ছোটাল। বিজয়ী দুজন। কার্ডন্ট সামনেই কোথাও আছে বিশ গজ না যেতেই আবার দুটো অন্ধকারের স্তূপ আলাদা হয়ে এল রাজপথের অন্ধকার থেকে।
‘আর এক পা এগুলেই মরবে’ শাসিয়ে ওঠে সেই স্তূপকৃত অন্ধকার।
‘মরবে রাজদ্রোহীরা’ গুলি চালাল দ্যার্তেগা আর পোর্থস একসাথে। গুলি আসে ও পক্ষ থেকেও একদিকে মারা পড়ে দার্তেগার ঘোড়া, ওদিকে বিদ্রোহীরা। একটা বাড়তি ঘোড়া সঙ্গে আছে, চোখের পলকেই তার পিঠে উঠে বসে দ্যার্তেগা, চলো কোথায় যাবে বোফক্ট? ধরেছি তাকে, এবার নির্ভয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলে দ্যার্তেগা আর পোর্থস।
‘থামো’ আবারও আসে কঠোর নির্দেশ। সামনের পথ আটকে দিয়েছে তৃতীয় একজোড়া অন্ধকার মূর্তি।
দ্যার্তেগা, পোর্থস উত্তর দেয় পিস্তলের মুখে, ওদিকের যোদ্ধারা ঘোড়াকে দাঁড়া করায় পিছনের পায়ের উপর। ফলে গুলি দুটোই বেঁধে যায় ঘোড়ার গলায়। দুটো ঘোড়াই উল্টে পড়ে যায় মাটিতে।
চোখের পলকে আরোহীরা লাফিয়ে নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। একজন কৌতুক করে বলে উঠে ‘ঘোড়ার পর ঘোড়া খুন করে আর কত বীরত্ব দেখাবেন? হিম্মত থাকে তো তরোয়াল হাতে এগিয়ে আসুন।’
পোর্থস জবাব দেয় ‘তরোয়াল? তা পেলে আর কিছুই চাই না।‘
পোর্থস আর দ্যার্তেগা ঘোড়া থেকে নেমে তরোয়াল হাতে এগিয়ে আসে।
একদিকে দুইজনে, ওদিকেও দুইজন।
দ্যার্তেগার নিয়ম হলো বিদ্যুতের বেগে তরোয়াল খাপমুক্ত করেই ঝড়ের বেগে আক্রমণ। তার সে আক্রমণ সহ্য করতে পারে এমন যোদ্ধা ফ্রান্সে আছে বলে সে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আজ তার প্রচণ্ড আঘাতই ব্যর্থ হলো, প্রতিপক্ষ ব্যর্থ করে দিয়েছে তার আঘাত ‘জাহান্নাম’ গর্জে উঠে দ্যার্তেগা সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় আঘাত হানে জাহান্নাম! দ্যার্তেগার এই বিশেষ শপথ বাক্যটি এবং সে উচ্চারণের বিশেষ ভঙ্গীটি যে প্রতিপক্ষ ওই যোদ্ধার একান্ত পরিচিত। আঘাতের উত্তরে প্রত্যাঘাতের চেষ্টা না করে সে যোদ্ধা এক লাফে তিন হাত পিছিয়ে গিয়েছে এবং সেই খান থেকে কুঁজো হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। অন্ধকারের জড়তা ভেদ করেও দ্যার্তেগার মুখ তার দেখা চাই।
ওদিকে পোর্থস আর তার প্রতিযোদ্ধা দুইজনের তরোয়াল ভেঙে গিয়েছে যুদ্ধ করতে গিয়ে। তারা এখন গুলি চালাচ্ছে। যে সামান্য ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে গুলি বেরোবার সময় তাতেই ক্ষনিকের জন্য দ্যার্তেগার মুখ আবছা ফুটে উঠল, অমনি দ্যার্তেগার প্রতিপক্ষের কণ্ঠ থেকে আর্তনাদ বের হলো ‘দ্যার্তেগা? অ্যারামিস। গুলি বন্ধ কর। গুলি বন্ধ কর’।
এ কণ্ঠস্বর ভুল হওয়ার নয়, দ্যার্তেগারও চিনতে কষ্ট হলো না, সেও প্রায় একই রকম তীক্ষ্ণস্বরে আর্তনাদ করে উঠল ‘অ্যাথোস?
পোর্থস বলে উঠল, ‘অ্যারামিস’।
অ্যারামিস বলে উঠল, ‘পোর্থস।‘
কী করুণ পরিস্থিতি! একদিন যারা ছিল এক আত্মার বন্ধু তারা আজ প্রাণের শত্রু। কে ধারণা করতে পেরেছিল যে দ্যার্তেগার সঙ্গে অ্যাথোস একদিন যুদ্ধে লিপ্ত হবে, কোন পাগলের মাথায় এ কল্পনা এসেছিল যে পোর্থস আর অ্যারামিস পরস্পরের টুটি ছিঁড়ে নেবার জন্য ক্ষেপে উঠবে একদিন?
‘ভবিতব্য।’ বলে কপালে চাপড় দিল দ্যার্তেগা, ‘সারা ফ্রান্সে একটি মাত্র মানুষ ছিল যে আমার তরোয়ালের সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। আজ কিনা সেই মানুষটিই আমার তরোয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল, আমার মর্যাদাকে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে?’
অ্যাথোসের প্রাণের বন্ধু দ্যার্তেগা। তার এই কাতর আর্তি অ্যাথোসের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে তুলল, সে এগিয়ে এসে দ্যার্তেগার সামনে দাঁড়াল তরোয়াল খাপে পুরে বলল ‘বন্ধু’ তোমার মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কাজ আমি করতে পারি না। তুমি তোমার তরোয়াল আমার বুকে গেঁথে দাও। কারণ জীবন থাকতে আমি বোফটকে ত্যাগ করতে পারব না।
‘তোমরা বোফক্টের পক্ষে সে কথা আগে বলনি কেন?’ দ্যার্তেগার গলায় তিক্ত অভিযোগ।
‘আমিও তোমার আর অ্যারামিসের কাছে গিয়েছিলাম? তখন কেন তোমাদের ইচ্ছা প্রকাশ করোনি।’
অ্যাথোস হঠাৎ এ অভিযোগের কোনো উত্তর দিতে পারল না। বলল, ‘এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আলোচনা করব। কাল পারি তো সাক্ষাত করব আমরা। তোমাদের সঙ্গে বড় ধরনের একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তা হোক, কিন্তু এতে আমাদের সারা জীবনের বন্ধুত্ব যাতে বিনষ্ট না হয়, তা আমাদের করতেই হবে।’
বেশি কথার সময় হলো না, প্রায় পঞ্চাশ জন ঘোড়া সওয়ারী নিয়ে বোফর্ট নিজে এসে পড়েছেন। তিনি অনেকটা এগিয়ে ছিলেন অ্যাথোস আর অ্যারামিসের দেরি দেখে তাদের খোঁজ নিতে ফিরে এসেছেন।