‘তা পারত না।’ শান্তস্বরে বলেন ক্রমওয়েল–‘কারণ যে জাহাজে তারা যাবে, তার খোলের ভেতর পাঁচ পিপে বারুদ বোঝাই করা আছে। ক্যাপ্টেন আমার হাতের লোক। গভীর রাতে বারুদে জ্বলন্ত পলতে সংযোগ করে দিয়ে সে তার নাবিকদের নিয়ে নৌকায় চড়ে পালাত। রাজার মৃত্যুর জন্য পৃথিবীর লোক ক্রমওয়েলকে আর দায়ী করত না। দায়ী করত তার ভাগ্যকে।’
মর্ডন্ট, নিজেকে যে পৃথিবীর সেরা ধূর্ত বলে মেন করে সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল তার মালিকের এই চরম ধূর্ততার পরিচয় পেয়ে, তাকে বিব্রত ভাব থেকে মুক্ত করলেন ক্রমওয়েলই–‘আমার কাছে কিছু তোমার বলার আছে?’
মর্ডন্ট তার কথা লুফে নিল—’হ্যাঁ মালিক, আমার একটা প্রার্থনা আছে, আমাদের হাতে একসময় দুজন ফরাসি বন্দি হয়েছিল। মালিক তখন সেই দুবন্দিকে আমাকে দিয়েছিলেন। আমি তখন তাদের ধরতে পারিনি, কারণ অন্য দুই ফরাসির সাহায্যে পালাতে পেরেছিল তারা। আজ আমার প্রার্থনা, মালিককে যদি আমার একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে খুশি করতে পারে তা হলে ওই চারজন ফরাসিকেই আমার হাতে দিন।’
‘নিতে পার এবং ওই যে জাহাজখানার কথা বলছিলাম, সেখানেও তুমি দুই একদিনের জন্য নিজের কাজে ব্যবহার করতে পার।’
এই বলে ক্রমওয়েল উঠলেন, ‘তোমার সঙ্গে বোধহয় দেহরক্ষী নেই?’ জিজ্ঞেস করলেন মর্ডন্টকে।
‘জ্বি না।’
‘তা হলে তুমি আমার সঙ্গেই চলল।’
‘না মালিক, এখানে আমি একটু সময় থাকব। একটু নিরিবিলি জায়গা দরকার আমার চিন্তা করার জন্য।’
ক্রমওয়েল রুমের দেয়ালের একটি বিশেষ স্থানে হাত দিয়ে চাপ দিলেন একটু। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ার সরে গিয়ে সেখানে বেরিয়ে এল একটি গুপ্ত দরজা। তারই ভেতর দিয়ে নিচে সুরঙ্গ পথে অদৃশ্য হলেন তিনি।
ঠিক তারপরেই রুমের জানালা দিয়ে উঁকি দিল দ্যার্তেগা। মর্ডন্ট গভীর চিন্তায় মগ্ন, কীভাবে নির্যাতর করে মার হত্যাকারী চারজন ফরাসিকে মৃত্যুকে মৃত্যুদ্বারে পাঠাবে তারই উপায় নিয়ে সে ভাবছে। সে ধ্যান তার যখন ভাঙল তখন একের পর একজন ফরাসি লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকে চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে।
মর্ডন্ট চমকে লাফিয়ে উঠল, তার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে, যাদের বারুদে উড়িয়ে দেবার জন্য বুদ্ধি ঠিক করে এখুনি কাজে নামবে বলে ভাবছিল খারাপ ভাগ্যের একটি মাত্র আঙ্গুলের ইশারায় তাদের কবলে পড়ে গেল মর্ডন্ট। এরা যে কোনো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে এভাবে ঘিরে ধরেনি, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে নেই।
কিন্তু মর্ডন্ট অস্থির হলো না। ঠাণ্ডা মাথায় তখনও চিন্তা করার শক্তি তার আছে। এই অপ্রত্যাশিত সংকট থেকে সে কিভবে মুক্তি পেতে পারে।
দ্যার্তেগাই প্রথম কথা বলল–‘তাহলে আবার দেখা হলো মিস্টার মর্ডন্ট।’
‘এই দেখাই হয়তো শেষ দেখা। ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটিয়ে মর্ডন্ট বলে। কারণ এ সাক্ষাৎকার থেকে জীবিত বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ যে আমার হবে না তা আমি বুঝতে পারছি। আমার অভাগিনী মাকে যেভাবে সেভাবেই আমাকে আজ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার মতলব তোমাদের।’
উত্তর দিল দ্যার্তেগা—’রাজার হত্যাকারী নরাধমকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার অধিকার যে কোনো সৎ লোকেরই আছে। কিন্তু আমরা তোমাকে হত্যা করব না। তোমাকে সুযোগ দিচ্ছি দ্বন্দ্ব যুদ্ধে বীরের মৃত্যুবরণ করার। আমাদের চার বন্ধুদের মধ্যে যার সঙ্গে ইচ্ছে তুমি যুদ্ধ করতে পার।’
আমার আবার ইচ্ছে—’অনিচ্ছা কী? যে কোনো একজন লড়তে পার আমার সঙ্গে, কিন্তু যুদ্ধে যদি আমি জিতি, তা হলে আমি মুক্তি পাব তো? না আবার দ্বিতীয় একজনের সঙ্গে লড়তে হবে নতুন করে?’
‘না, তা হবে না। একজনের সঙ্গে যুদ্ধে জিততে পারলেই তুমি মুক্তি পাবে।’
এরপর দ্যার্তেগার সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু হলো মর্ডন্টের। সে শুধু আত্মরক্ষা করে যাচ্ছে, আর ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে, সরতে সরতে সেই বিশেষ স্থানটিতে তার পৌঁছনোর মতলব যেখান থেকে গুপ্ত দরজা পথে একটু আগেই ক্রমওয়েল ভূগর্ভের সুরঙ্গে নেমে গিয়েছেন।
দ্যার্তেগা সে গুপ্ত দরজার কথা জানে না। কাজেই মর্ডন্টের ক্রমাগত স্থান পরিবর্তনের উপর কোনো গুরুত্ব সে দিচ্ছে না।
মর্ডন্টের উদ্দেশ্য কিন্তু হাসিল হতে বসেছে। দ্যাগের আক্রমণ সহ্য করবার শক্তি তার প্রায় শেষ। ঠিক এমন সময়ে সে গিয়ে সেই বিশেষ জায়গায় পৌঁছাল। দ্যার্তেগা তাকে দেয়ালের সঙ্গে গেঁথে ফেলার জন্য তরোয়াল হাকিয়েছে। এমন সময়ে মর্ডন্টের দেহের চাপে গুপ্ত দরজা খুলে গেল এবং চোখের পলকে মর্ডন্ট অদৃশ্য হয়ে গেল।
দ্যার্তেগা ছুটে আসার আগেই গোপন দরজা আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে এমনভাবে মিলিয়ে গেছে যে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার অবস্থানটা এরা বের করতে পারল না। ওদিকে মর্ডন্ট হাসছে। দেয়ালের পিছনে হাসির উচ্চস্বর ক্রমশ কমতে কমতে এক সময়ে মিলিয়ে গেল।
চার বন্ধু সব দেয়ালে আঘাত করতে লাগল, তবুও গুপ্ত দরজা খুঁজে পেল না, কিন্তু না, এখন সময় নষ্ট করা বোকার কাজ। তাদের জন্য গ্রীন উইচ বন্দরে জাহাজ অপেক্ষা করছে, এখনও হয়তো পালানো যেতে পারে। দেরি করলে আবার কতই না বিপদ এসে হাজির হতে পারে। এখানে মর্ডন্ট সর্বশক্তিমান।
ওরা ছুটল হোটেলে। এখনই গ্রীন উইচ রওনা হওয়া চাই ভাড়া টাড়া মিটিয়ে। গ্রীন উইচ পর্যন্ত ঘোড়াতেই যাবে, সঙ্গে প্যারীর ভাই যাচ্ছে। সে ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসবে। তারপর সে আর তার ভাই প্যারী ঘোড়াগুলো বেচে টাকাটা ভাগ করে নেবে।