হঠাৎ একটা অতি মৃদুস্বর উপরের কাঠের পাটাতন ভেদ করে এসে অ্যাথোসের কানে প্রবেশ করল, শিউরে উঠল অ্যাথোসের সমস্ত শরীর, এ স্বর চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। এ কণ্ঠস্বর রাজার। রাজা শুয়ে কথা বলছেন। নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে ঘাততের কুঠার তার মাথার উপরে উদ্যত রয়েছে, মুখোশ পড়ে এসেছে ঘাতক। শুধু একটা কালো দড়ির ডগা দেখা যাচ্ছে মুখোশের নীচ থেকে। রাজা শেষ শোয়ার আগে তাকে বলেছেন ‘হঠাৎ আমাকে আঘাত করো না, আমি যখন বলব ‘মনে রেখো তখনই আঘাত করবে। কুঠারের এক আঘাতেই শেষ করতে পারবে তো?’
ঘাতক শুকনো গলায় উত্তর দিল ‘চেষ্টা করব।’
এখন শুয়ে শুয়ে রাজা অতি মৃদুস্বরে বলছেন–‘কাউন্ট-দ্যা-লা ফেয়ার আপনি কি নিচে আছেন?’
অ্যাথোসের কানে এল একটা উত্তর ‘আছি।’ সে উত্তর যে অ্যাথোসের নিজেরই তা তার বিশ্বাস হতে চায় না যেন, এ স্বর তার স্বর নয়। এ উত্তর তার গলা থেকে বেরুল কখন? সে তো টের পায়নি।
উপর থেকে আবার শোনা গেল, ‘যা মানুষের পক্ষে করা সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি আপনি করেছেন, আপনি এবং আপনার তিন বন্ধু। ঈশ্বর আপানদের মঙ্গল করবেন। আমার স্ত্রী কন্যাকে খবর দেবেন, সাহসে বুক। বাধতে বলবেন। এ অন্যায়ের প্রতিকার একদিন হবেই, আমার বড় ছেলে হল্যান্ডে আছে, তার জন্য দশ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা লুকনো রইল। নিউক্যাসল দুর্গের মাটির নিচের যে ঘর আপনাকে আমি দেখিয়েছিলাম, সেই কক্ষে, ঈশান কোনো ভিত্তির নিচে রাখা আছে, আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না এই স্বর্ণ মুদ্রার কথা।’
দৃঢ়স্বরে বলে অ্যাথোস ‘এ অর্থ যুবরাজ পাবেন।’
এবার রাজার গলার স্বর সুস্পষ্ট হলো। উঁচু হলো। তিনি ভরাট গলায় বললেন, ‘মনে রেখো।’
রাজদ্রোহী লক্ষ্য দর্শকের মনে হলো এটা তাদের মাথার উপর মৃত্যুপথ যাত্রী রাজার শেষ অভিশাপ, তারা আঁতকে উঠল, একমাত্র জানল–এ সতর্কবানী তাকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত হয়েছে, যাতে প্রিন্স অব ওয়েলেস এর জন্য রাখা শেষ মিলিয়টির কথা সে ভুলে না যায়। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আঘাতে মাথার উপরের কাঠের পাটাতন দুলে উঠল, আর কী যেন এক ফোঁটা গরম জিনিস এসে পড়ল অ্যাথোসের কপালে, সে কেঁপে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।
ফোঁটা পরে স্রোত হয়ে ঝরতে লাগল অ্যাথোসের পায়ের কাছটিতে। তাজা গরম টকটকে লাল রক্ত, অ্যাথোস পকেট থেকে রুমাল বের করে নিয়ে সেই রক্ত ভালো করে মাখল রুমালে তার রাজার শেষ চিহ্ন।
কীভাবে সেই নরক থেকে বেরিয়ে কোন পথে অ্যাথোস হোটেলে এসে পৌঁছল তা তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে সে বলতে পারত না।
মাস্কেটনের সঙ্গে প্রথমেই দেখা, সে তখন পাহারা দিচ্ছে বন্দি ঘাতককে। না, লোকটি পালায়নি। আজকের কাজটি যার হাত দিয়েই হয়ে থাকুক, সে যেই হোক না কেন, লন্ডনের সরকারী ঘাতক যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘লোকটাকে ছেড়ে যাও মাস্কেটন,’ অ্যাথোস বলল।
অ্যারামিস এল, পোর্থস এল, অনেক পরে এল দ্যার্তেগা, এসেই বন্ধুদের বলল, ‘কে জানে এই হত্যাকারী? সেই মর্ডন্ট।’
‘মর্ডন্ট-আর একবার নতুন করে সকলের শিউরে উঠার পালা, এই নররাক্ষস, এই পিশাচ কি তাদের সকলকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য এসেছে এই পৃথিবীতে? উইন্টার গেলেন, রাজা গেলেন, এবার কি এই চার বন্ধুর পালা?’
কিন্তু দ্যার্তেগা ভাবার সময় দিল না। সবাইকে তাড়া দিয়ে নিয়ে গেল শহরের বাইরে এক নির্জন স্থানে, সেখনে একটা ছোট বাড়িতে মর্ডন্ট ঢুকেছে, দ্যার্তেগা জানে, কারণ বধ্যভুমি থেকে মর্ডন্টকে অনুসরণ করে সে এই বাড়ি পর্যন্ত এসেছিল। মর্ডন্ট বাড়ির ভিতর ঢুকার পরে বাড়ির পিছনে গ্রিমডকে এবং বাড়ির বাইরে অন্য এক অনুগত ব্যক্তিকে পাহারায় রেখে সে গিয়েছিল বন্ধুদের ডাকতে। এই অনুগত লোকটি হলো প্যারীর ভাই, যাকে ওরা শুশ্রষা করে বাঁচিয়ে তুলেছিল সেদিন।
তখন দুজন অনেক কথা বলছে ঘরের ভেতর। একজন মর্ডন্ট অন্যজন স্বয়ং ক্রমওয়েল। ক্রমওয়েলেরই এই বাড়ি। এরকম বাড়ি অনেকগুলি আছে। তার লন্ডন শহরে, এক এক স্থানে এক একটি। পরপর দুইদিন এক বাড়িতে থাকেন না তিনি। অনেক সময় সকালে এক বাড়িতে বিকালে অন্য বাড়িতে।
ক্রমওয়েল বলছেন—’আমি জানি না কে এসে ঘাতকের কাজটি করে দিয়ে গেল, জানতেও চাই না, এক কাজের জন্য পুরস্কার হোক, সাজা হোক যা পাওয়ার সে তার ঈশ্বরের কাছ থেকে পাবে। আমার কিছু বলার নেই তাকে।’
‘কিন্তু রাজাকে হত্যা করার দরকার ছিল। আপনার কাজই তো সে করেছে। ঠিক সময়ে সে যদি হাজির না হত।’
আবেগের সঙ্গে বলে উঠে ক্রমওয়েল ‘বড়ই ভালোই হত, মর্ডন্ট।’
‘ভালো হত? ও যদি হাজির না হত, হত্যা কাণ্ডটা আজ হতে পারত না। এবং রাত্রে চার্লস স্টুয়াট পালাতে পারত।
‘পালাতে পারত! মর্ডন্ট যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।’
‘নিশ্চয়ই পারত পালাতে, হোয়াইট হলের ভেতর চারজন ফরাসি সুরঙ্গ কেটেছে মিস্ত্রির ছদ্মবেশে। আজ রাতে চার্লস স্টুয়াট ওই পথে পালাত। আজ তিন দিন থেকে গ্রীন উইচ সমুদ্র কুলে চালর্স এর জন্য ছোট একটা জাহাজ ভাড়া করে রাখা হয়েছে। সেই জাহাজে ওই ফরাসিরা আজ রাতেই চার্লসকে নিয়ে পালাত। আমি মুক্তি পেতাম রাজহত্যার অপবাদ থেকে।’
মর্ডন্ট তিক্তস্বরে বলে ওঠে–‘অপবাদ থেকে মুক্তি হয়তো পেতেন, কিন্তু অত বড় শত্রু জীবিত অবস্থায় যদি ফ্রান্স গিয়ে উঠতে পারত।’