‘কালকে না হোক পরশু সম্ভব হতে পারে।’
‘তা পারে। তবে আমাদের কাজ একটা রাত্রি পেলেই হয়ে যাবে, আমরা আপনাকে কাল রাতে উদ্ধার করব।‘’
অবাক হয়ে যান রাজা, সমস্ত পরিকল্পনা তাকে খুলে বলে অ্যারামিস, ওরা বধ্যমঞ্চ বানিয়েছে ঠিক রাজার জানালার সামনে, যে ঠিকাদারের উপর এই মঞ্চ বানাবর ভার পড়েছে, সে লোকের অভাবে অসুবিধায় পড়েছিল, কাল কোনো মিস্ত্রি রাজী হয়নি রাজাকে হত্যা করার জন্য মঞ্চ বানাতে, শেষ মুহূর্তে খুব সস্তাতেই সে দুজন মিস্ত্রি পেয়েছে, সে দুজন মিস্ত্রি হলো অ্যাথোস আর পোর্থস।
রাজা চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, অ্যারামিস তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর বলে চলল তার পরিকল্পনা, ‘এক্ষুণি তারা মঞ্চ বানাতে শুরু করবে, কাঠের মাচাটা হয়ে গেলেই ওরা তার উপর থেকে একটা সুরঙ্গ খুড়বে আপনার প্রাসাদের দেয়ালে। ঠিক জানালার নিচে কাঠের আবরণের নিচে চাপা থাকবে সুরঙ্গের মুখ, আর সেই সুরঙ্গ দিয়ে অ্যাথোস এসে ঢুকবে আপনার এই রুমে। নিচের ঘরে। সে ঘর খালি আছে। অন্য কোনো লোক আপনার নাগালের মধ্যে থাকতে দেবে না বলে।’
‘এখন অ্যাথোস নিচে থেকে এই ঘরের মেঝে খুঁড়ে ফেলবে, তিন চার খানা টালি খুলতে পারলেই আপনি সেই গর্ত দিয়ে গলে নিচের ঘরে নামতে পারবেন, সেখান থেকে সুরঙ্গ পথে মঞ্চের ভেতর, সেখানে কোনো মিস্ত্রি বা মজুরের কাপড় পড়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন। একটি ছোট জাহাজ ভাড়া করা রয়েছে গ্রীণউইচে, সমুদ্রের ধারে, আপনি তাতে উঠলেই জাহাজ ফরাসি উপকূলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলবে।’
এই রোমাঞ্চকর পরিকল্পনা রাজা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন।
এরা মানুষ, না মহামানুষ এই ফরাসিরা।
.
পরের দিন, বেলা দশটার আগেই বধ্যমঞ্চ তৈরি করা হয়ে গিয়েছে, যাতে সমবেত জনগন সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে পায়, তাই মঞ্চটি দোতালা করে তৈরি করা হয়েছে, হত্যা কাণ্ডটি ঘটবে দোতালায়, রাজাকে কোনো কষ্ট করতে হবে না, জানালা পথ দিয়ে সোজা একবারে মঞ্চে উপস্থিত হতে পারবেন।
মঞ্চের নিচে মোটা কালো কাপড়ে ঢাকা। বাঁশ, খুটির কদর্য কাঠামোটা লোকের চোখে যাতে বিশ্রী না দেখায় সেজন্য এরই আড়ালে অ্যাথোস সুরঙ্গ খুঁড়ছে, রাজার ঘরের ঠিক নিচে যখন অ্যাথোস পৌঁছুল একটি খাটো মই নিয়ে, তখন বেলা আন্দাজ নয়টা। সব কাজ প্রায় শেষ, এখন রাজার ঘরের মেঝে থেকে কয়েকটা টালি খুলে নেয়া শুধু বাকি।
এখনও তার সময় হয়নি, আজ যে প্রাণদণ্ড হতে পারে না, যে সেটা আজ মুলতবি রইল-এই আদেশটি প্রচারিত হোক আগে। এখনও যে আদেশ জারি হয়নি, কারণ ঘাতক যে নিরুদ্দেশ, কর্মকর্তারা তা এখনও জানেন না, জানবেন, যখন বেলা দশটায় তার খোঁজ পড়বে তখন।
বাইরে লোকে লোকারণ্য। এখন অসংখ্য লোক রান্নার ঘরে। পাদ্রী এবং প্রহরী অ্যারামিস রাজাকে ফিস্ ফিস্ করে সাহস দিচ্ছে।
‘অ্যাথোস ঠিক আপনার পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে আছে, এখানকার ভিড় একটু হালকা হলে আমি এখান থেকে সংকেত দেব, আর যেই টালি ফাঁক করবে, তারপর আরকি! গ্রীন উইচের মুক্তি।’
.
অধীর আগ্রহে অ্যাথোস প্রতীক্ষা করছে, উপরের ঘর খালি হলেই সংকেত দেবে অ্যারামিস, রুমের মেঝেতে পর পর তিনবার পায়ের আওয়াজ করে, সেই সংকেত পাওয়া মাত্র টালি আলগা করতে শুরু করবে অ্যাথোস। কাজ আর কতক্ষণ? তারপর ধৈর্য্য ধরে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করা। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসলেই রাজা নেমে যাবেন সুরঙ্গ পথ দিয়ে মজুরের ছদ্মবেশে বধ্যমঞ্চ থেকে বেরিয়ে।
কিন্তু কই অ্যারামিস তো সংকেত দেয় না। অথচ মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না উপরের ঘরে, মানুষের পায়ের শব্দও পাওয়া যায় না, ঘরটা নিস্তব্দ, অথচ কেন নীরব অ্যারামিস?
ওদিক একটা গমগম আওয়াজ উঠছে প্রাসাদের বাইরে যেখানে একত্র হয়েছে লক্ষ লক্ষ লোক, তারা নিঃশব্দ নিস্পন্দ থাকলেও সেখানে ওই রকম একটা শব্দ উঠবেই, কিন্তু অ্যাথোস বুঝতে পারছে না–ওখানে এখনও লক্ষ লোক থাকবে কেন? অনেকক্ষণ হলো দশটা বেজে গিয়েছে, এতক্ষণে নিঃশব্দ ঘোষণা হয়ে গেছে যে, ঘাতকের অনুপস্থিতির জন্য রাজার দণ্ড আজকের মতো মুলতবি রইল। তবে লোকগুলো ওখানে কি করছে? বুকের ভেতরটা টিপটিপ করছে অ্যাথোসের। সে কোনো মতেই আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না, সুরঙ্গ পথ বেয়ে বেরিয়ে এল বধ্য মঞ্চের নিচের তলায়, মোটা কাপড়ের পর্দা দিয়ে যে জায়গাটা ঘেরা আছে, সেই পর্দার এক কোনো ফাঁক করে সে যে দৃশ্য দেখতে পেল, তাতে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, মানুষ, মানুষ, আরো মানুষ, কাতারে কাতারে আছে চোখ বিস্ফোরিত করে, স্থানটি হলো ঠিক মাথার উপরের স্থানটি, অর্থাৎ যেখানে রাজার শিরোচ্ছেদ হওয়ার কথা। সেখানটিতে।
তবে কি সেই বিভীষিকার দৃশ্য ঘটতে যাচ্ছে যা চাচ্ছে এই রাজদ্রোহী প্রজারা। অ্যাথোস কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তার চোখের আড়ালে রাজবলির শেষ দৃশ্য কি এক্ষুণি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? তবে কি ঘাতকটা গুপ্ত স্থান থেকে বেরিয়ে এসেছে কোনো রকমে? অসম্ভব, তার পাহারায় রয়েছে গ্রিমড, তার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসবে ওই ঘাতক, এটা অসম্ভব, তবে কি অন্য ঘাতক পেয়েছে ওরা? নিশ্চয়ই তাই, কিন্তু লন্ডনে তো আর ঘাতক নেই।