নির্বিকার, উদাসীন, টেমস নদী বয়ে চলেছে এক রাজার পতন হলো, তার কিছুই এসে যাচ্ছে না। আবার একদিন যদি এই ক্রমওয়েলের পতন হয়, সেদিনও তার কিছুই যাবে আসবে না। সময়ের উপর যদিও বা মানুষ দাগ রেখে যেতে পারে কিন্তু জল প্রবাহের উপর কোনোভাবেই পারে না।
সঙ্গে আরও তিনটে নোক নিয়ে আনন্দে পায়চারী করছে ওই জানোয়ারটা যে রাজার মুখে থুথু ছিটিয়ে ছিল।
দ্যার্তেগার চারজন কাছে এসে দাঁড়াল। গ্রিমডের তিনজন একটু দূরে। হঠাৎ চারজন চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরল।
অ্যারামিস ভোজালি বের করল।
‘না, ভদ্রলোকের জন্য ইস্পাতের আঘাত, এটা জানোয়ার, এর জন্য অন্য ব্যবস্থা।’ দ্যার্তেগা দুই হাত বাড়িয়ে ঘাড় ধরল লোকটার। সে আউ করে উঠল। প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল হাত ছাড়াবার। তার সঙ্গীরা দেখলেন এই আততায়ীরা সশস্ত্র হিংস্র, ভাবছে পালাবে কি না?
দ্যার্তেগা বলে উঠল, ‘পোর্থস, এক ঘুষিতে এই লোকটার মাথা নিশ্চয়ই গুড়ো করে দিতে পারো তুমি।’
পোর্থসের হাতটি উবু হয়ে উঠল, যম দণ্ডের মতো। একটা প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়ল ওর ব্রহ্ম তালুর উপর। একখানা কাগজ যেন ছিঁড়ে গেলো ফাত করে। মাথাটা ছাতু হয়ে গিয়েছে একবারে, গলগল করে রক্ত বেরুলো। দ্যার্তেগা ছেড়ে দিতেই শরীরটা ধড়াস করে মাটিতে পড়ে গেল। ওর সঙ্গের লোক তিনটা ছুটে পালাল। তা যাক–যাকে শাস্তি দেয়ার দরকার ছিল। তাকে দেয়া হয়েছে।
অ্যাথোস এসে দ্যার্তেগা হাত ধরল। ‘তোমার কাছে রাজার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভার দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম।’
.
রাজা একজন পাদ্রী চেয়েছেন। যিনি তাকে ধর্মোপদেশ দিতে পারবেন। আর্চ বিশপের উপর ভর দিয়েছেন পার্লামেন্ট। রাত দশটার সময় একজন ধর্ম যাজক রাজার কাছে যাবেন, বলে জানিয়েছেন আর্চ বিশপ।
প্রহরীদের দলপতির কাছে ঠিক রাত দশটার সময় হোয়াইট হলে এল একজন পাদ্রী, অভিজ্ঞান দেখাল আর্কবিশপের। দলপতি পাদ্রীকে সম্মান দেখিয়ে পৌঁছে দিল রাজার রুমে। বিশ্বস্ত সহকারী আর্চ বিশপের। পাদ্রী জ্যাকসন।
বিছানায় শুয়েছিলে রাজা, বাইবেল পড়ে শোনাচ্ছিল তাকে প্যারী পাদ্রীর ঘরে ঢুকতেই প্যারী উঠে দাঁড়াল, রাজা উঠে বসলেন।
‘মহারাজ আমি গির্জার সান্ত্বনার বানী নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।’ রাজার কাছে কণ্ঠস্বরটি কি পরিচিত মনে হলো? তা না হলে তিনি চমকে উঠে পাদ্রীর মুখের দিকে চাইলেন কেন?
লম্বা কালো দাড়ি পাদ্রীর মুখে, এক মুহূর্তের জন্য সেই দাড়ি সরে গেল। রাজা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, ‘শিভালিয়ার দ্যা হারবেন?’
ঠিকমত দাড়ি লাগিয়ে অ্যারামিস বলল–‘না-পাদ্রী জ্যাকসন। আমরা এখনও আশা ত্যাগ করিনি মহারাজ, আপনার আশে পাশেই আমরা আছি। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব।’
করুন হাসলেন রাজা–‘আপনার এবং কাউনস্ট দ্য-লা ফেয়ার এর বন্ধুত্বের তুলনা হয় না। বন্ধুত্ব আর উদারতাই বলুন এ এক স্বর্গীয় বস্তু, আমি আপনাদের কেউ নই অথচ এই নিঃসম্পর্কীয় অপরিচিত, বিদেশী। ভাগ্যহীন রাজার জন্য বারবার আপনারা যেভাবে নিজেদের প্রাণকে বিপন্ন করছেন।’
‘আমরা আপনার স্ত্রী ও কন্যার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’ রাজা উত্তর দেয় অ্যারামিস ‘সে কথা যাক, কাল বিচারালয়ে ওরা কি আদেশ দেয়। তাই দেখে আমরা কাজ স্থির করব এবং কাল রাত্রে এভাবে এসে আপনাকে জানাব।’
‘প্রতিদিন একবার করে এভাবে জীবন বিপন্ন করা–একটা সত্যিকারের বিপদ ঘটে যেতে কতক্ষণ শিভালিয়ার?’ মৃদু কণ্ঠে রাজা প্রতিবাদ করেন।
কথা আজ আর বাড়াতে পারল না। প্রহরীর দলপতি এসে জানাল নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। রাজা নিচু হয়ে অ্যারামিসের হাতের ক্রুশ চুম্বন করলেন, অ্যারামিস মার্জিত ল্যাটিনে আশাবাণী উচ্চারণ করল। তারপর প্রহরীর সঙ্গে চলে গেল।
রাজা বিছানার পাশে নতজানু হয়ে বসলেন উপসনার জন্য। পার্লামেন্ট পরের দিন ঘোষণা করল–রাজা চালর্স এর প্রাণদণ্ড হবে প্রজাদ্রোহের অপরাধে এবং এই দণ্ড কার্যকর হবে ঠিক পরের দিন বেলা দশটাতে হোয়াইট হলে রাজার শয়ন কক্ষের বাইরে।
রাজা শোবার ঘরে ঠিক রাত দশটার সময় অ্যারামিস আবার দেখা করল। রাজার সঙ্গে। আজ শেষ রাত রাজার জীবনের, কাজেই বেশিক্ষণ থাকার অনুমতি পেয়েছে সে। অ্যারমিস করল–‘এখনও হতাশ হবেন না মহারাজ।’
রাজা হেসে বললেন ‘আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এখনো আশা করার মতো অবশিষ্ট কিছু আছে কি? কাল বেলা দশটাতেই ঘাতকের কুঠার আমার শিরচ্ছেদ করবে।’
‘কিন্তু সে ঘাতক নিখোঁজ হয়েছে মহারাজ, কাল দশটার সময় তাকে কোথাও পাওয়া যাবে না,’ জানাল অ্যারামিস।
‘সেকি!’
‘বন্ধু দ্যার্তেগার অসাধ্য কিছু নেই, ঘাতককে ঘুষ দিয়ে সে বশ করেছে, আমরা তাকে পাঁচশো পাউন্ড দিয়েছি, তার নিজেরও রাজ হত্যায় বিতৃষ্ণা ছিল। তারপর এরকম একটা মওকা পেয়ে গেল, সে একভাবে মদ খাচ্ছে আমাদের হোটেলের রুমে বসে। এ ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে আর বেরুবে না।’
রাজার প্রশ্ন ‘সে না বেরুক, ওরা কি আর ঘাতক পাবে না?’
‘ওই একমাত্র ঘাতক লন্ডন শহরে। আর এটা নিশ্চয়ই তো শখ করে কেউ আসবে না এই ঘৃণিত কাজ করার জন্যে, কাজেই অন্য শহর থেকে একজন ব্যবসাদার ঘাতক আনতে হবে ওদের। সেটা কালকে সম্ভব নয়।’