একটা শুকনো নদী, তার উপরে পুল, দ্যার্তেগা ঘোড়া নিয়ে সেই নদীর খাদের ভেতর নামল, সঙ্গে অন্য সবাইও। পুলে থামের তলায় আত্মগোপন করল তারা, কয়েক মিনিটের ভেতরই একদল সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলে গেল সেই পুলের উপর দিয়ে। ওরা পিছু নিয়েছে পলাতকদের। নদীর খাদ থেকে উঠে এসে আর রাজপথ ধরল না পলাতকেরা, মাঠ ভেঙে পাহাড় পেরিয়ে অনেক কষ্ট ভোগ করে তিন দিন পর এসে পৌঁছালো লন্ডনে।
৮. মাঠ পাহাড় পেরিয়ে
৮.
দ্যার্তেগারা সোজা মাঠ পাহাড় পেরিয়ে আসার জন্য দূরত্ব কিছুটা কমেছে। সন্দেহ নাই, কিন্তু তেমনি আবার বলে জঙ্গলে লুকিয়েও থাকতে হয়েছে অনেক সময়, ফলে মর্ডন্ট আর তার শত্রুরা প্রায় একই সাথে রাজধানীতে ঢুকল।
যে সৈন্যদল রাজাকে লন্ডন নিয়ে এসেছে, মর্ডন্ট তার অধিনায়ক। রাজাকে সোজা তার প্রাসাদের নিয়ে যাওয়া হলো। টাওয়ার বা কোনো কারাগারে নয়, একেবারে হোয়াইট হলে। কড়া পাহারায় সেখানেই তাকে রাখা হবে, যতক্ষণ না বিচার হচ্ছে এবং বিচার অনুযায়ী দণ্ড।
দণ্ড যে হবেই, তা ওয়াকিবহাল সবাই জানে, কারণ বিচার করবে পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট রাজার অনুরক্ত সদস্য ছিল বেশি, তাদের সব বিদায় করা হয়েছে ক্রমওয়েলর হুকুমে। এখন যারা আছেন, তারা রাজদ্রোহীও বটেই, তারা জনে জনে রাজার ব্যক্তিগত শত্রু।
বিচার প্রহসনের আয়োজন করতে থাকুক ক্রমওয়েলের আজ্ঞাবাহীরা। আমরা ততক্ষণে চার নিঃস্বার্থ ফরাসি বীরের কাজ কারবার দেখি।
.
লন্ডনে এসেই অ্যাথোসের পূর্ব পরিচিত এক হোটেলে গিয়ে উঠল। অতি সাধারণ হোটেল, দামও সস্তা, তবে খাবার দেয় ভালোই, সবচেয়ে বড় কথা। এখানে খরিদ্দারের রুচি অনুযায়ী খাবার মেলে।
খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা যখন হয়ে গেল, পরবর্তী কাজ হলো প্রত্যেকের জন্য এক প্রস্থ করে পোষাক তৈরি করানো, আগেই বেশভূষা। পাল্টানো দরকার, নইলে মর্ডন্টের চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে না।
সাধারণ পোষাকই বেছে নিল ওরা, এক একজনে এক এক রকম। সবই অসামরিক পোষাক, কেউ সাজল ব্যবসায়ী, কেউ চাষী, কেউ দালাল, কেউ মহাজন।
বিভিন্ন রকমের পোষাক পরে চার বন্ধু রাজার বিচার দেখার জন্য অবশেষে বেরুল। হোয়াইট হলের অনেকটা দূরে সুরক্ষিত আদালত ঘরে বিচার সভা বসেছে। ।
পার্লামেন্টের সদস্যরা যেখানে আসন গ্রহণ করেছেন, তাদের সামনে রাজাকে হাজির করা হয়েছে।
ক্রমওয়েলের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি মর্ডন্ট হাজির আছে। রাজাকে বসতে দেয়া হয়েছে। তিনি তাতে বসে হাতের ছড়ি দিয়ে পায়ের জুতোর উপর আঘাত করছেন।
একটা অভিযোগের ফিরিস্তি বলে গেল, কাগজপত্র দেখে আদালতের একজন কর্মচারী শোষণ, কুশাসন, ধর্মদ্রোহ, প্রজাপীড়ন এসব অভিযোগসহ প্রধান বিচার সভার সভাপতি বললেন–‘চার্লস স্টুয়াট, তোমার বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগ সম্বন্ধে তোমার কিছু বলার আছে?’
রাজা উত্তর দিলেন–‘আগে তোমরা বলো যে আমার বিচার করার ক্ষমতা তোমরা পেলে কোথায়, তার পরে আমি যা বলার তা বলব।’
সভাপতি উত্তর দিলেন—’সব অধিকারেরই উৎস হলো জনসাধারণ। যেজন সাধারণ তোমার বিচার করতে চাইছে।’
অকস্মাৎ একটা বাজ পড়ল যেন সভাঘরে। দর্শকদের বেঞ্চের উপরে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল একটা মামুলি পোশাক পড়া আধবয়সী লোক, আর চেঁচিয়ে উঠল–‘মিথ্যা কথা! ঘোর মিথ্যা কথা, ইংরেজ অধিকাংশই রাজভক্ত। প্রমাণ দেখতে চাও? পার্লামেন্টের অর্ধেকর বেশি সদস্য পার্লামেন্ট ত্যাগ করে গিয়েছেন এই বিচার প্রহসনের প্রতিবাদে।’
‘বন্দি কর, বন্দি কর। এরা সেই পলাতক–ফরাসিরা।’ চিৎকার করে উঠল মর্ডন্ট, প্রহরীরা ছুটে এলো দর্শকের দিকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ভিড় ঠেলে আসা সহজ নয়। তারা এসে পৌঁছার আগেই অ্যাথোস (ওই প্রতিবাদকারী অ্যাথোস ছাড়া কেউ নয়) এবং তার বন্ধুরা ছুটে বেরিয়ে পড়েছে বিচার কক্ষ থেকে।
বাইরে জনারণ্যে মিশে গিয়ে তারা তখনকার মতো নিরাপদ হলো সন্দেহ নেই, কিন্তু এভাবে আত্মসংযম হারালে আবার বিপদে পড়তে কতক্ষণ? দ্যার্তেগা বোঝাতে লাগল–‘রাজার জন্য কীভাবে কখন কী করা যায়, তার সম্পূর্ণ ভার কি তোমরা আমার উপর দিতে পারছ না? এভাবে আবেগে পরিচালিত হলে কাজ উদ্ধার তো হবেই না, উল্টো আমরাই বন্দি হয়ে পড়ব।’
সভার অধিবেশন বেশিক্ষণ চলল না, কিছুক্ষণ পরেই প্রহরী ঘেরা রাজাকে দেখা গেল বিচারালয়ের বাইরে–সেখানে কি ভিড়! রাজার অনুরাগীরা আত্মপ্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছে না, রাজদ্রোহীদেরই প্রচণ্ড দাপট সেই ভিড়ের ভেতর। চারদিক থেকে তারা রুখে পড়েছে, উঁচু গলায় বাজে কথা বলছে, প্রহরীরা অতিকষ্টে রাস্তা করে নিয়ে চলেছে রাজাকে। একটা লোক সামনে এগিয়ে এসে রাজার মুখে থুথু দিল।
অ্যাথোস গর্জে উঠল। যেন তার বুকের ভেতর তরোয়াল বিধিয়ে দিয়েছে, তার মুখে হাত চাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি দ্যার্তেগা, পোর্থস টেনে নিয়ে গেল অ্যাথোসকে।
চোখের বাইরে যেতে দিচ্ছে না ওই লোকটাকে দ্যার্তেগা, হালকা হচ্ছে। ভিড়। আরও দুই তিনজনের সঙ্গে মিলে ওই জানোয়ারটা হেলে দুলে দুজনে চলছে নদীর দিকে। মেজাজ তার খুব ভালো। নিজের বাহাদুরীর তারিফ নিচ্ছে অন্য সবার কাছে। তার পিছনেই যে চারজন অনুসরণ করছে সে তার কিছুই জানে না।