দ্যার্তেগার মুখে থেকে ওই সংকেত বেরুনো মাত্র বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বাইরের দিকে ছুটবেন, পোষাক পরেই তাকে কাল শুতে হবে। চাকরেরা নিজেদের সাতটা ঘোড়া ছাড়াও অতিরিক্ত আরও দুটো ঘোড়া সাজিয়ে নেবে হ্যারিসনের আস্তাবল থেকে, এ সব ঘোড়া নিয়ে তারা শিবিরের বাইরে অপেক্ষা করবে, কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না, কারণ অশ্বারোহীরা সারা রাত দলে দলে আসছে, দলে দলে বেরুচ্ছে, ঘোড়ার আনাগোনা, কার ঘোড়া কোথায়, এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
অ্যাথোস আর অ্যারামিস বন্দি, কাজেই তরোয়াল থাকবে না ওদের, থাকবে জামার ভেতরে পিস্তল আর ভোজালি, তারই সাহায্যে পাহারাওয়ালা সৈনিকদের ঘায়েল করে তরোয়াল যোগাড় করে নেবে ওরা।
পরের দিন সন্ধ্যে বেলা, সবাইকে আর এক দফা তালিম দিয়ে নিল দ্যার্তেগা ডিনারের পর। চাকরেরা ঘোড়া নিয়ে ঠিক কোনখানে অপেক্ষা করবে, তা দিনের বেলাতেই তাদের দেখিয়ে এনেছে। এখন তাদের কাছে প্রশ্ন—’ঘোড়াগুলোকে নিয়ে ভালো করে খাওয়ান হয়েছে তো? ওদের জিন লাগাম রেকাব সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে তো? ওদের জুতোর নাল সব ঠিক আছে তো? ঘোড়ার পায়ের নালের একটা পেরেক খুলে গেলে একটা লড়াই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বার বার সে কথা দ্যার্তেগা স্মরণ করিয়ে দেয়। পোৰ্থস মাঝে মাঝে মাথা নাড়ে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। দ্যার্তেগা তার কাঁধে হাত রেখে বলে কিছু টাকা গ্রসলোকে পেতে দিও, বন্ধু। জিতলে ও জেতার নেশাতেই মেতে থাকবে, অন্য কোনো দিকে তাকাবে না।’
অ্যাথোস আর অ্যারামিস অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে দ্যার্তেগাকে তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে তারা, জামার ভেতরে গুলি ভরা। পিস্তল আর ভোজালি নিয়েছে, এক একজনকে দুটো শত্রু নিপাত করতে হবে। কারণ এরা চারজন আর গ্রসলোরা আটজন। তা হয়ে যাবে এখন। সবাই রাত নয়টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ল, রাজার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে পাশাপাশি ঘর। একটি ঘর রাজার জন্য, আর একটি প্রহরীদের জন্য। দ্যার্তেগারা গিয়ে দেখে রাজা বিছানায় শুয়ে পড়েছেন, গায়ের চাদরের তলায় তার দিনের বেলার পোষাক দেখা যাচ্ছে, তার পায়ের কাছে বসে বাইবেল পড়ে শোনাচ্ছেন তাকে। রাজা আধবোজা চোখে শুয়ে শুয়েও শুনছেন, আর মাঝে মাঝে বলছেন, তারপর?
দ্যার্তেগাকে সোল্লাসে অভ্যর্থনা করল গ্রসলো।
গ্ৰসলো প্রহরীদের আগে থাকতেই বলে রেখেছিলেন। তারা বেশ আগ্রহ দেখাতে লাগল খেলার ব্যাপারটাতে। জুয়া খেলার উপর আসক্তি সৈনিকদের যেন মজ্জাগত।
টেবিলের চারকোণে বসল দ্যার্তেগা আর পোর্থস, গ্রসলো আর তার সহকারী প্রহরীদের কাছেই বসল অ্যাথোস আর অ্যারামিস, সংকেত উচ্চারণের সাথে সাথেই যাতে চোখের পলকে চারজন শত্রু খতম করা যায়, এমনি ভাবে কায়দা করে বসেছে চারজন। তারপর? তারপর ওরাও চারজন, ওরাও চারজন, মুখোমুখি লড়াইয়ে দ্যার্তেগার সঙ্গে সমানে সমানে লড়বে, এমন যোদ্ধা ইংল্যান্ডে কে আছে?
খেলার ফাঁকে ফাঁকে ঘরের ভেতরে যেখানে রাজা শুয়ে আছেন, সে দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে দ্যার্তেগা। প্রহরীদের চোখ আর রাজার উপর নেই, খেলার টেবিলের দিকেই তাকিয়ে আছে তারা।
খেলা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, সেখানে, যার হাতে রাজা মার্কা তাস এসে পড়বে, জিতবে সেই। পোর্থস তাস তুলল না রাজা নয়, গ্রসলে তুলল না দ্যাগো তুলল–ঈশ্বর এই তো রাত গ্লাসে চেঁচি… উঠল–‘এবার তা হলে ঘরের ভেতর বিছানার উপর রাজা নড়ে উঠলেন। প্যারী বাইবেল রেখে উঠে দাঁড়াল। অ্যাথোস আর অ্যারামিস জামার ভেতরে হাত দিয়ে পিস্তল ধরেছে, দ্যার্তেগা আর পোর্থস লাফিয়ে উঠে হাত দিয়েছে কোমরের তরবারিতে–এমনি সময়ে বন্ধ দরজা হঠাৎ করে খুলে গেল, একটা ব্যস্ত মুখ দেখা গেল দরজায়, সে মুখ কর্নেল হ্যারিসনের।
বাজ পড়ল গ্রসলোর মাথায়, এ সময়ে এখানে কর্নেল আসবেন, মশগুল অবস্থায় জুয়া খেলা হাতেনাতে ধরে ফেলবেন তাকে, এ স্বপ্নেরও বাইরে, কিন্তু গ্রসলার দিকে কর্নেলের চোখ নয়, তিনি সোজা চলে গেলেন ভেতরের ঘরে, আর কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন ‘চার্লস স্টুয়ার্ট! তোমার ভাগ্যে আর রাতের বিশ্রাম নেই, এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে লন্ডনে রওনা হতে হবে, এই বার্তা নিয়ে এসেছেন, জেনারেলের বিশেষ দূত।’
সে দূত আর অন্য কেউ নয়, মর্ডন্ট।
দ্যার্তেগাদেরও মাথায় বাজ। ইংল্যান্ডের ইতিহাস অন্যরকম লিখতে পারত তারা–আর মাত্র দুমিনিট সময় পেলে। তা তারা পেল না। একা হ্যারিসন হলেও বা এ জুয়া খেলার একটা কৈফিয়ত দেয় সম্ভব ছিল, কিন্তু হ্যারিসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শনি মর্ডন্ট। এক পলকের মধ্যে জীবন মরণ কোনটা ঘটে যায়, কিছু বলা যায় না।
রাজার দিকেই প্রথমটায় তাকিয়ে ছিল মর্ডন্ট, কিন্তু পরক্ষণেই চোখ পড়ল দ্যার্তেগার উপর। সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত উল্লাসে ঝকমক করে উঠল তার চোখ আর মুখ। সে চেঁচিয়ে বলল–‘ওই সেই পলাতক ফরাসিরা! আটকাও মারো শেষ করে দাও।’
কিন্তু ততক্ষণে পলাতক ফরাসিরা আর ঘরের ভেতরে নেই, তরোয়াল খুলে দ্যার্তেগা পোর্থর্স ছুটে বেরিয়েছে, তাদের পায়ে পায়ে অ্যাথোস আর অ্যারামিস পিস্তল হাতে, রাজা উদ্ধার হলো না। এখন সবচেয়ে বড় দরকার আত্মরক্ষার। ছুট, ছুট ঘোড়া নিয়ে গ্রিমডেরা তৈরি আছে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে রিস্টন পেরিয়ে দূরে-বহুদুরে