হ্যারিসনের সঙ্গে তারা সত্যই সন্ধ্যার পরে মিলিত হল। দ্যার্তেগা পোর্থসকে দেখেছেন হ্যারিসন ক্রমওয়েলের দরবারে এবং মর্ডন্টের আশেপাশে তারা যে এখন এই সৈন্যদলের সঙ্গে মিলে লন্ডনের দিকে যেতে চাইবে, এটাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলেই মনে হলো হ্যারিসনের ‘পিছিয়ে পড়ছিলে কেন? শুধু একবার মাত্র জিজ্ঞাসা করলেন।
দ্যার্তেগা উত্তর দিল, আর বলেন কেন? আমাদের এই বন্দি দুজনের জন্য। ওরা একবার আশা দিয়েছিল নিউক্যাসল থেকেই মুক্তিপনের ব্যবস্থা করে নিজেরাও মুক্তি নেবে। আমাদেরও মুক্তি দেবে। শেষ পর্যন্ত সে ব্যবস্থা আকাশ কুসুমে পরিণত হলো। তাই ওদের লেজে বেঁধে রওনা হতে হলো। মাঝখান থেকে দামী সময়ের অপব্যয়। কিন্তু আসার সময় এক বাড়িতে আপনাদের হাতের কিছু কাজ দেখে এলাম, একটা লোক খেতে বসেছেন হ্যারিসনের চোট বড় কয়েকটা টেবিল জুড়ে, বন্দি সহ দ্যার্তেগারাও বসেছে একটা ছোট টেবিলে। সবার থেকে একটু দূরে আর একটা ছোট টেবিলে খেতে বসেছেন রাজা একা। তাকে পরিবেশন করছে তারই ব্যক্তিগত চাকর প্যারী। সেই প্যারীকে শোনাবার জন্যই গলাটা অস্বাভাবিক উঁচু করল দ্যার্তেগা ‘একটা লোক মাথা দু’ফাঁক হয়ে পড়ে আছে। আঘাতটা যার হাত থেকে এসেছে, সে লোক বাহাদুর সেনাপতি। মানুষটা আর একটু হলেই শেষ হয়ে যেত।’
হ্যারিসনের টেবিল থেকেই একটা ষণ্ডা লোক বলে উঠল, ‘শেষ হয়ে যেত? তাহলে শেষ হয়নি, অ্যাঁ? আমি তো ভেবেছিলাম’…
সান্ত্বনার সুরে দ্যার্তেগা বলল, তার জন্য আফসোস করবেন না ভাই, শেষ যে হয়ে যায়নি, সে শুধু তার বরাত জোরে। আপনার দিক থেকে ত্রুটি কিছু ছিল না, তা আমরা দেখেই বুঝতে পেরেছি। সত্যি অদ্ভুত কব্জির জোর দেখিয়েছেন আপনি। খালি হাতে ওরকম মাথা ফাটিয়ে দেয়া না, না অসাধারণ বাহাদুরি আপনার। একসঙ্গে যখন চলেছি, আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে আলাপ করব আপনার সঙ্গে। শক্তিশালী লোক দেখলেই আনন্দ হয় একটা।
শক্তিশালী লোকটার নাম গ্ৰসলো। হ্যারিসনই আলাপ করিয়ে দিলেন। আলাপের সুত্রে প্রকাশ পেল প্যারিসে গ্রসলো বেশ কিছুদিন ছিল, অল্প স্বল্প ফরাসি ভাষাটা বলতে পারে।
দ্যার্তেগাকে আর পায়কে, সে গ্রসলোকে জানাল, লেফটেন্যান্ট গ্রসলো, কী চমৎকার জ্ঞান আপনার ফরাসি ভাষাতে। এমন সুন্দর ফরাসি অনেক সময় খাস ফরাসিরাও বলতে পারে না। তা আপনার সময়ে বেশ আনন্দে কাটছে তো? আমি আর আমার বন্ধু ভ্যালন, আমরা ভাই ভারী অসুবিধায় পড়েছি, আমরা ভাই আমুদে লোক সন্ধ্যাবেলা একহাত তাস খেলতে না পারলে আমাদের ডিনার হজম হয় না। এখানে তো… এই বলেই মুখ দিয়ে একটা আফসোসের আওয়াজ বার করল দ্যার্তেগা।
কথাটা লুফে নিল এসলো, আর বলবেন না ভাই। আমারও ওই একই সমস্যা। তাস আমার ধ্যান, তাস আমার জ্ঞান, যে দিন তাসে অন্তত পাঁচটা পাউন্ড জিততে না পারি, সেদিনটা আমার বৃথা গেল মনে হয়। যুদ্ধের সময়ও অবাধে খেলা চলেছে। কেল্লায় ক্যাম্পে খেলার সাথীর অভাব কোথাও হয় না, কিন্তু ইদানীং পড়েছি ঝকমারীতে। রাজার পাহারার ভার আমার উপরেই পড়ে প্রতি রাত্রে না পারি নিজে বাইরে যেতে, না পারি বাইরের লোক ভেতরে আনতে। খেলতে না পেরে আমার পেট ফুলে ওঠার অবস্থা। গ্রসলোর মনোভাব যখন এরকম, দ্যার্তেগার তখন তার সুযোগ নিতে দেরি হবে কেন?
সে দিন ডাবি শহরে রাতের বিশ্রাম ঠিক হয়েছে। আজ গ্রসলোকে পাহারা দিতে হবে না। গ্ৰসলোকে নিজের ঘরে ডেকে আনল দ্যার্তেগা। এক বন্ধুকে নিয়ে গ্রসলো এলো। একদিকে গ্রসলো আর তার বন্ধু অন্যদিকে দ্যার্তেগা আর পেপার্থস। কুড়ি পাউন্ড হেরে ঘসলোরা বিদায় নিল।
কাল রাত কাটার কথা রিষ্টন শহরে। শোধ নেব ওখানে, গ্রসলো বিদায় নেবার সময় বলে বসলো।
‘কালও বুঝি তোমার পাহারা নেই।’
‘আছে, আছে, পাহারা দিতে দিতেই খেলব। আজ আমরা এলাম তোমাদের ঘরে, কাল তোমরা যাবে আমাদের ঘরে। অর্থাৎ স্টুয়ার্টের ঘরে। রাজাকে এখন ওরা আর রাজা বলে না,’ চার্লস স্টুয়ার্ট বলে।
দ্যার্তেগা সব খুঁটিয়ে জেনে নিল। যেদিন যেখানে রাজার রাতের থাকার ব্যবস্থা হয়, জোড়া কামরাতে রাখা হয় তাকে। প্যারীকে নিয়ে রাজা ভেতরের কামরায় থাকেন আর আটজন প্রহরী নিয়ে গ্রসলো থাকে দ্বিতীয় কামরায়। দুই কামরার ভেতর খোলা দরজা, সেই দরজার উপর বসে থাকে প্রহরীরা, যাতে এক মুহূর্তের জন্যও রাজা চোখের বাইরে না থাকেন।
সব ব্যবস্থা বুঝিয়ে দিয়ে গ্রসলো বলে বাইরের ঘরে বসে আমরা খেলব, ভেতরে শুয়ে থাকবে স্টুয়ার্ট তাতে অসুবিধা কি?
চিন্তিতভাবে দ্যার্তেগা বলে–‘অসুবিধা আর কিছু নয়, অসুবিধা শুধু আমাদের বন্দি দুজনকে নিয়ে, ওদের রেখে এলে ওরা পালাতে পারে। আমাদের চাকরেরা বিশ্বাসী ঠিকই, কিন্তু তারাও অস্ত্র ধরতে জানে না, অথচ বন্দিরা ওস্তাদ তরোয়ালবাজ, না, ওদের রেখে এনে নগদ চার হাজার পাউন্ড মারা যাবার আশঙ্কা রয়েছে বন্ধু, এক একজনের মুক্তিপণ ঠিক হয়েছে দুই হাজার, ফ্রান্সে পৌঁছেই ওরা দেবে বলেছে—’
‘দূর এসব চিন্তা বাদ দাও’–রেগে গ্রসলো বলে, ‘বন্দি দুটোকে না হয় সঙ্গেই নিয়ে এসো। বাইরের ঘরে আটজন প্রহরীর মাঝে ওরা নিরাপদ থাকবে।’
‘দ্যার্তেগার এখন কাজ হলো সব কথা প্যারীকে জানানো। কাল রিষ্টন শহরে গভীর রাতে রাজাকে উদ্ধার করার একটা চেষ্টা করা হবে, রাজা যেন সতর্ক থাকেন। সংকেত শব্দ হলো ‘এবার তাহলে—’’