বাড়ি যখন আছে, সেখানে মানুষও আছে এবং খাবারও আছে, সুতরাং কষ্ট করে এই মাঠটুকু পেরুতেই যা দেরি। তারপরই তো ডিনারের কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে।
চার বন্ধু তিন চাকর এবং সাতটা ঘোড়া-এই চৌদ্দটি ক্ষুধার্ত প্রাণী বাড়িটার দিকে ছুটে চলল—সেই সাদা ছোট বাড়িটার দিকে।
মাঠ পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে বাড়ি।
বাড়িটার এটা পিছন দিক। ওরা ঘুরে সামনের দিক দিয়েই ঢুকবে স্থির করল। কারণ পিছন দিক দিয়ে যারা ঢোকে, তাদের চট করে চোর ডাকাতের পর্যায়ে ফেলে দেবার একটা বদ অভ্যাস সাধারণত মানুষের থাকে।
কী কাণ্ড, বাড়ির সামনেই যে চওড়া রাস্তা, এ দেখে অ্যাথস মন্তব্য করে এই তাহলে লন্ডন-নিউক্যাসল রাজপথ। নিজেদেরকে যতটা নিরাপদ ভাবা যাচ্ছিল ততটা আমরা নই তাহলে।
দ্যার্তেগা রাস্তার ধুলোর দিকে তাকাচ্ছিল, দেখে বলল–আপাতত বোধহয় নিরাপদ আমরা। বিপদ যাদের দিক থেকে আসতে পারত তারা কিছুক্ষণ আগেই লন্ডনের দিকে যাত্রা করেছে। এই দেখ অসংখ্য ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন। সব লন্ডনের দিকে।
অ্যাথোসের মুখে নীরব জিজ্ঞাসা ‘তবে কি?’
তাই নিশ্চয়ই। এ হলো হ্যারিসনের সৈন্যদল। শুনেছিলাম যে, ‘হ্যারিসন রাজাকে লন্ডনে নিয়ে যাবে।’
‘রাজাও তাহলে?’ অ্যাথোসের প্রশ্ন একটা আর্তনাদের মতো শোনায়। ‘হ্যাঁ রাজাও আছেন এদের সাথে। আমরাও ভিড়ে যাই ওই সৈন্যদলে। রাজার কাছাকাছি থাকতে তো পরবই তাছাড়া আরও এক লাভ আছে। মর্ডন্ট আজ হোক কাল হোক আমাদের সন্ধান করবেই, কিন্তু সে যতই চালাক হোক, এটা তার মগজে কখনই ঢুকবে না যে পলাতকরা পালিয়ে যায়নি। হ্যারিসনেরই বাহিনীর সঙ্গে মিলে মিশে লন্ডনের দিকে ধীরে সুস্থে সামনে এগুচ্ছে।’
‘কিন্তু বাড়িটার ভেতরে একবার গিয়ে ডিনারের একটা চেষ্টা করার কথা ছিল না? পেটের মধ্যে যে আগুন জ্বলে।’ এ বক্তব্য পোর্থসের। অ্যারামিস টিটকারী দিল–‘চল ঘুরে আসি একবার বাড়িটার ভেতরে। কিন্তু যে পথ দিয়ে একটা সৈন্যদল গিয়েছে, সে পথের পাশে কোনো বাড়িতে এক বিন্দু খাবার পড়ে থাকে, এমনটা আমি আগে কখনও দেখিনি।’
তবু অ্যারামিসই আগে বাড়ির ভেতর ঢুকল। দরজা খোলা, এটা সন্দেহজনক বাড়িতে লোক থাকলে দরজা বন্ধ থাকত।
যা হোক, খোলা দরজা দিয়ে ওরা একটা ছোট হল ঘরে ঢুকল। লোকজন নেই, যদিও অনেক লোক এখানে একটু আগে বসে ছিল, খেয়েছিল, তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে, হল পেরিয়ে ওরা আরও ভেতরে ঢুকল। এবার একজন লোক দেখতে পাওয়া গেল। সে দাঁড়িয়েও নেই বসেও নেই রুমের মেঝেতে শুয়ে আছে।
আর মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তের ঢেউতে।
লোকটা বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ, বেঁচে থাকলেও জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে আছে, নিস্পন্দন তার দেহ।
গ্রিমড এসে তার বুকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল, আছে। বেঁচে আছে। এখনও, জল পাওয়া গেল একটু খুঁজতেই। চোখে মুখে দিতেই সে চোখ মেলল।
লোকটার মাথা দুফাঁক হয়ে গিয়েছে, কোনো একটা ভারী জিনিসের আঘাত লেগেছিল বলে মনে হয়।
এরা সবাই মোটামুটি প্রাথমিক চিকিৎসা জানে, আহত লোকটির মাথায় পট্টি বেঁধে রক্ত মুছিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হল। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের কথা বলল–রাজার ব্যক্তিগত ভৃত্য প্যারী আমার ভাই। এ বাড়ি আমার। রাজাকে বন্দি করে নিয়ে সেনাপতি হ্যারিসন এই পথ দিয়েই লন্ডনের দিকে গেল। প্যারী আছে রাজার সঙ্গে।
চোর ডাকাতের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এ বাড়িতে একটা গুপ্ত কুঠরি আমি তৈরি করেছিলাম। ওর ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে দুরবর্তী বনভূমিতে গিয়ে পৌঁছান যায়। প্যারী তা জানত। ওরই সুযোগ নিয়ে রাজকে উদ্ধার করার একটা চেষ্টা সে করতে চেয়েছিল। এই বাড়ির সামনে দিয়ে যাব যার সময় প্যারী সেনাপতিকে অনুনয় করে বলে, এখান থেকে রাজাকে এক পেয়ালা কফি খাইয়ে নিতে চাই।
হ্যারিসন আপত্তি করল না। কারণ তার নিজেরও খাওয়ার দরকার ছিল, ভেতরে ঢুকেই প্যারী আমায় ইশারা করল। আমি সে ইশারা বুঝলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য প্যারীর ইশারা যে হ্যারিসনের চোখ এড়ায়নি, তা আমি বুঝতে পারিনি। হাত মুখ ধোয়ার অজুহাতে আমি রাজাকে পিছনের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ইচ্ছা ছিল ওখান থেকে রাজাকে গুপ্ত কুঠুরিতে ঢোকাব, আর এক মিনিট সময় পেলে ঠিকই ঢোকাতে পারতাম। কিন্তু সে সময় আর পেলাম না।
একটা ভয়ানক শক্তিশালী লোক পিছন থেকে আমাকে এমন এক ঘুষি মারল যে আমার মাথার তালু দু’ফাঁক হয়ে রক্তের স্রোত বেরুল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম জবাই করা পশুর মতো। বাড়ির মধ্যে যেন প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়েছে, জ্ঞান হারাতে হারাতে আমি টের গেলাম।
বিফল হয়েছে রাজাকে উদ্ধার করার প্রথম চেষ্টা। এক গরীব প্রজা চেষ্টা করেছিল রাজাকে উদ্ধার করার, সে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছেন কোনো রকমে। অথবা শেষ পর্যন্ত বাঁচবে কিনা, বলাও যায় না। সেবা করার কেউ রইল না।
বাড়িতে খাবার বলে কোনো বস্তু নেই। যা কিছু ছিল হ্যারিসর নিয়ে গিয়েছে। পোর্থসের ডিনারের আশা মিলিয়ে গেল।
আহত লোকটাকে সাহস ও সান্ত্বনা দিয়ে খালি পেটেই দ্যার্তেগারা বিদায় নিল। ঘোড়া ছুঁটিয়ে গেলে বোধহয় সন্ধ্যার পরেই হ্যারিসনের সঙ্গে মিলিত হওয়া যাবে। অন্য সব বড় কারণ বাদ দিলেও মিলিত হওয়ার আসল কারণ হলো এটা যে, হ্যারিসনের বাবুচি খানা ছাড়া খাবার পাওয়া যাবে না এ পথে কোথাও। সৈন্যদল যে পথ দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, সে পথের দু’পাশের যা খাবার, তারা ঝেটিয়ে তুলে নিয়ে যায়, এতো সবাই জানে।