‘অ্যাথোসের ঠোঁটে একটু করুণ হাসি খেলে যায়–না দেশ ত্যাগ করে আসিনি এবং ত্যাগ করব না কোনো দিনও। কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞা করে দেশ থেকে বেরিয়েছি, সে প্রতিজ্ঞা পালন না করেও ফিরতে পারি না।’
‘প্রতিজ্ঞা? মানে রাজা চার্লস এর সাহায্য? অন্ধকার হয়ে আসে দ্যার্তেগার মুখ–সে প্রতিজ্ঞা রাখার জন্য তোমরা কি যথাসাধ্য চেষ্টা করনি? বারবার নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছ ওই রাজার সেবা করতে গিয়ে, তিনি এখন তোমাদের সেবার বাইরে চলে গিয়েছে, তোমরা আর কি করতে পার শুনি?’
আপন মনেই যেন স্বগতোক্তি করে অ্যাথোস–‘রাজাকে উদ্ধার করতে পারি।’ চমকে উঠে দ্যার্তেগা! পোর্থসও ওঠে। অ্যারামিসও। যুক্তি বুদ্ধির ধার না ধেরে সম্ভব অসম্ভব বিবেচনা না করে। নিছক ভাবাবেগের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়া যে কত বড় ঝকমারি, তা অ্যাথোসের সহকর্মী বন্ধুরা আগে বহুবারই অনুভব করেছে, কিন্তু পুরো বিশ বছর কেটে যাওয়ার পরও অ্যাথোসের মনোবৃত্তি সেই ডন কুইক্সেটের এক গুয়ে গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এমনটা দেখাবার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না।
কয়েক মিনিট নীরব থাকার পরে দ্যার্তেগা কষ্টের হাসি হাসে খানিকটা। রাজাকে একটা পুরো রেজিমেন্ট ঘিরে রেখেছে। সেই ঘেরাওর মধ্যে দিয়ে রাজাকে উদ্ধার করে আনা…
‘হয়তো সত্যিই অসম্ভব। দ্যার্তেগার কথা শেষ করে অ্যাথোস। বিশ বছর আগে হয়তো অসম্ভব ছিল না, কারণ তখন আমরা চারজন ছিলাম, এখন মাত্র দুইজন।’
দ্যার্তেগার মুখে চাবুকের মতো এসে লাগল ওই তিরস্কার। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না, কিন্তু পোর্থ সরল উদার পোর্থস হাত বাড়িয়ে অ্যাথোসের হাত চেপে ধরল—’কে বলে দুজন?’
‘আমরা চিরদিন চারজন ছিলাম, এখনও চারজন, মনে নেই আমাদের যৌবনের সেই মিলন মন্ত্র একে চার চারে একই’ ম্যাজারিন বা আমাদেরকে আর ক্রমওয়েলেই বা আমাদেরকে। তবে অ্যাথোস যদি আমাদের ডাকে তবে… পৃথিবীর হাতে এমন কোনো প্রলোভন নেই, যা দিয়ে সে আমাদের পিছু টেনে রাখতে পারে।
দ্যার্তেগা এগিয়ে এসে অন্য হাত ধরল অ্যাথোসের। পোর্থর্স ঠিকই বলেছে সারা পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যার আকর্ষণ আমাদের অ্যাথোসের থেকে দূরে টেনে রাখতে পারে। ওই মিলন মন্ত্র যেমন বিশ বছর আগে সত্য ছিল, আজও তেমনি আছে, একে চার চারে এক।
তখন সে কি কোলাকুলি গলাগলি, চার বন্ধুতে মিলে, অ্যাথোস আবেগ জড়িত স্বরে বলে ‘বন্ধুগণ! আমি জানি একাজ আমার পক্ষে অমার্জনীয় স্বার্থপরতা হচ্ছে নিজের নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার নিজস্ব ব্যাপারে তোমাদের সকলকে টেনে নিয়ে যাওয়া, তোমাদের উপর দাবি আছে বলেই তা করতে পারছি, কেন করছি তা বলা উচিত। আমি ভুলতে পারি না, রানী হেনরিয়েটার সেই কাতর অনুরোধ তার স্বামী এরকম মারাত্মক সংকটে উপস্থিত হতে পারে আশংকা করেই তিনি আমাদের সাহায্য ভিক্ষা চেয়েছিলেন। আমি আর অ্যারামিস মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলাম যে সাহায্য আমরা করব।’
‘স্বীকার করছিলাম বই কী?’ দৃঢ় স্বরে সায় দিল অ্যারমিস।
অ্যাথোস কৃতজ্ঞভাবে তার দিকে মাথা নেড়ে আবার বলতে থাকে, দ্যার্তেগা পোর্থস কে সম্বোধন করে। আজ সেই সময় এসেছে, রানী হেনরিয়েটার সবচেয়ে মর্মান্তিক আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। রাজা চার্লস বন্দি, তার জীবন শত্রুর হাতে বিপন্ন। একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর উইন্টার মৃত। এই সময়ে বন্ধুহীন বন্দি রাজাকে ত্যাগ করে দেশে চলে যাওয়া কি মানুষের কাজ? আমি যদি সে কাজ করি, হেনরিয়েটাকে গিয়ে কি বলব আমি? আমি আর অ্যারামিস? এই কথাই কি বলব যে রাজা বন্দি হওয়ার পর আমাদের আর করার কিছু ছিল না বলেই আমরা চলে এসেছি, এটা জানা কথা এখন তারা রাজাকে হত্যা করবে, আর তা দাঁড়িয়ে দেখার জন্য আমরা লন্ডনে বসে থেকে করব কি?
দ্যার্তেগা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—’না বন্ধু, ঠিকই বলেছ তুমি, পরে গিয়ে হেনরিয়েটাকে ‘পারলাম না কিছু করতে’ বলার সময় এখনও আসেনি, এখনও চেষ্টা করার অনেক কিছু আছে। কাজ কীভাবে শুরু করা যায়, সেটা সবাই মিলে ভেবে দেখি।’ পোর্থস তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কাজ আরম্ভ করা উচিত ডিনার দিয়ে। সকালের খাবারটা মারা গেল ওই মর্ডন্টের উৎপাতে, তৈরি খাবার খেয়ে আসা গেল না, লাঞ্চের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ লাঞ্চের সময়টা ঘোড়ার পিঠেই কেটেছে, কিন্তু ডিনার? এখন তো আর পালাচ্ছি না। সুতরাং খেয়ে নিতে অসুবিধা কি?
দ্যার্তেগা জবাব দেয় বিমর্ষভাবে, ‘অসুবিধা সামান্যই, কিন্তু মারাত্মক। সেটা এই যে ডিনারের কিছুই সঙ্গে নেই, পালাবার তাড়ায় আমরা খাবার আনতে পারিনি কিছুই।’
একথা হঠাৎ কেউ বিশ্বাস করতে রাজী হয় না, মাস্কেটন এবং গ্রিমডের মতো এক জোড়া পোড় খাওয়া পুরাতন চাকর সঙ্গে থাকতেও তারা পালাবার সময় কিছুমাত্র খাবার সঙ্গে আনেনি। এটা যেন বিশ্বাসের অযোগ্য মনে হয়। কিন্তু প্রত্যেকের কাছে যাচাই করে যখন জানা গেল যে দ্যার্তেগার সন্দেহ ষোলো আনা সৎ। তখন হতাশ ভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল ওরা যে খাবারের খোঁজে তাহলে বন ছেড়ে বের হওয়া দরকার।
বনের বাইরে একটা মাঠ, মাঠের ওপারে আবার বন। সেই বনের আড়ালে যে একটা সাদা বাড়ি আছে, এটা মস্কেটন আবিস্কার করল।