এক কোণে কর্মচারীরা আগুন জ্বালিয়ে ছিল, সেখান থেকে এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা তুলে তারে জড়িয়ে নিল দ্যার্তেগা, তারপর তার সহ কয়লার টুকরা হাতে নিয়ে সে ঘোড়ার লাগাম ধরে বাইরে এলো, গেটের সামনে প্রহরীরা জমায়েত হয়ে আছে আটজন, আর একটু সামনে গ্রিমড, মাস্কেটন প্রস্তুত রয়েছে নিজেদের ঘোড়া নিয়ে।
দ্যার্তেগা প্রহরীদের সামনে আবার আগেই ঘোড়ায় উঠে পড়ল, তারপর সকলের অজান্তে হাতের সেই জ্বলন্ত কয়লা ঢুকিয়ে দিল নিজের ঘোড়ার কানের ভেতর, সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ঘোড়াটা, আর পেছনের পায়ে খাড়া হলো। একবারে দ্যার্তেগার মতো দক্ষ আরোহী না হলে সে অবস্থায় কেউ ঘোড়ার পিঠে ঠিকমতো বসে থাকতে পারে না। দ্যার্তেগা পায়ের প্রবল চাপ এবং হাতের তেমনি শক্তিশালী চাপ দিয়ে তাকে আবার চার পা মাটিতে নামাতে বাধ্য করল বটে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এমন কৌশলে জুতোর স্লাম দিয়ে তার পেটে গুতো দিল যে ঘোড়াটা পাগলের মতো ঘুরপাক খেতে খেতে প্রহরীদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। এই হঠাৎ উৎপাতে যেন আহত হতে না হয়, এজন্য প্রহরীরা তাড়াতাড়ি পিছু সরে গেল, এমন সময় দ্যার্তেগা যেন ঘোড়ার কাণ্ড কারখানায় ভয় পেয়েই আর্তনাদ করে উঠল–‘ঈশ্বর রক্ষা কর’ বলে। ঘোড়ার কানের ভেতর তখনও আগুন জ্বলছে, ঘোড়াটা তখনও পিছনের পা তুলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। সে যদি কারও গায়ের উপর দিয়ে পড়ে এই ভয়ে প্রহরীরা ক্রমশ আরও পিছনে সরে যাচ্ছে, এমন সময়ে ঘরের ভেতর থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো—’পোর্থস, অ্যাথোস এবং অ্যারামিস।’
প্রহরীদের চোখ তখনও দ্যার্তেগার ঘোড়ার দিকে, বন্দিরা পালাচ্ছে এটা তারা লক্ষ্য করার আগেই পোর্থর্সরা প্রায় দ্যার্তেগার কাছে চলে এসেছে। তখন প্রহরীরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল, ‘বন্দিরা পালাচ্ছে, ধর ধর’ এবং এক সাথে ছুটে এসে পথ আটকে দাঁড়াবার চেষ্টা, কিন্তু সামনে বাধা হয়ে আছে দ্যার্তেগা, এখন তার ঘোড়া আর লাফাচ্ছে না, কারণ কাউকে না দেখিয়েই দ্যার্তেগা আগুনটা বের করে ফেলেছে তার সহ, ঘোড়া লাফাচ্ছে না এবং দ্যার্তেগার দুই হাতে দুই পিস্তল, প্রহরীরা পিস্তল নিয়ে আসেনি, সুতরাং যে এগুবে, তার নিশ্চিত মৃত্যু।
পোর্থস, অ্যাথোস, অ্যারামিস ছুটে এগিয়ে গিয়েছে, উঠেছে গিয়ে নিজের নিজের ঘোড়ায়। এবার দ্যার্তেগা নিজের ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিল, তখন প্রহরীরাও ছুটে এল, কিন্তু ঘোড়ার পিঠে চড়া ছুটন্ত পলাতকদের পিছু ধাওয়া পায়ে হেঁটে যায় না। তারা ছুটল আস্তাবলে, ঘোড়া নিয়ে আসার জন্য। ঘোড়া আনবে তাতে উঠবে, তারপর পিছু নেবে, সে এখন অনেক দূর। এদিকে দ্যার্তেগারা বাতাসের বেগে ছুটছে।
.
৭.
এই তো জীবন–এই তো আনন্দ। এই তো ফুর্তি।
নিজের স্বাধীনতা নিজের হাতে। পায়ের তলায় শক্ত মাটি, পিছনে পড়ে আছে নিষ্ঠুর খুনী, সামনে খোলা পৃথিবী আর স্বাধীনতা।
সাতটা ঘোড়ার বেগে ছুটছে নিউক্যাসল থেকে এসে। এদের মাথায় এখনও আসছে না রাস্তায় কোনো লোকজন নেই, যদিও সর্বসাধারণ এ পথ ব্যবহার করে না, যুদ্ধের ভয়ে পালিয়েছে লোকজন? হয়তো তাই হবে।
অনুসরণ করেনি মর্ডন্ট। টিলার মাথায় উঠে মাঝে মাঝে ওরা পিছন ফিরে দেখেছে। নিউ ক্যাসল পর্যন্ত উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো পথের কোথাও শত্রুর কোনো চিহ্ন নেই। এরই বা মানে কি?
ঘোড়ার রশি আলগা দিল ওরা। শত্রুর দেশ এই স্কটল্যান্ড, তবু কি সুন্দর। যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন যদি ভুলে যাওয়া যেত। সত্যি কথা, চার বন্ধু পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে ঠিক বিশ বছর আগের মতো, কেমন যেন বিস্ময় লাগে, মাঝে এতগুলো দিন তাদের রোজকার সমস্যা নিয়ে এসেছে, গিয়েছে এ যেন বিশ্বাস করাই কঠিন মনে হয়।
বিকাল নাগাদ ওরা একটা বনভূমিতে ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলো ঘাস খেতে লেগে গেল। তাই দেখে পোর্থস পোর্টের উপর হাত দিয়ে একটা চড় মেরে বলল, তাই তো, এখন আমরা খাই কি? ডিনারের বেলা যে যায়।
অ্যারামিস প্রতিবাদ করে ‘ডিনারের আবার বেলা অবেলা কী, যখন জুটবে তখনই বেলা। এখন যখন জোটেনি, তখন এটা অবেলা।’
মন্তব্য করে দ্যার্তেগা ‘এটা খুব জ্ঞানের কথা, সুতরাং ডিনারে যাওয়ার কথা নিয়ে বাজে আলোচনা না করে, এসো কাজের কথা বলি, সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর কত দূরে হতে পারে, সে ধারণা কারও আছে?’
না সে ধারণা কারও নেই।
অ্যাথোস শুধু বলে–‘সমুদ্র বন্দরের কথা তুলছ, তোমরা কি তাহলে ফ্রান্সে ফিরে যেতে চাইছ?’
আকাশ থেকে পড়ল দ্যার্তেগা–‘আমরা না তোমরা? ফ্রান্সে ফিরে যেতে চাইছ সেটা ঠিক। কারণ ফ্রান্স ছাড়া আর কোথায় যেতে চাইব? যেতে চাইছি ঠিকই, কিন্তু যাওয়াটাই তো শক্ত।’
তাহলে বিদায় বন্ধু দ্যার্তেগা, বন্ধু পোর্থস এবং ধন্যবাদ তোমরা যে উপকার করেছ, তা তোমরা ছাড়া আর কেউ করতে পারত না, যুদ্ধে আমার আর অ্যারামিসের প্রাণ যাওয়া অনিবার্যই ছিল, সে প্রাণ বাঁচিয়েছ তোমরা। এখন আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকা আমাদের কোনো লাভ তো নেই, তোমরাও পদে পদে অসুবিধায় পড়বে আমরা সঙ্গে থাকলে, সুতরাং যা বলেছি বিদায়।
‘দ্যার্তেগা আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। অ্যাথোস এসব কি পাগলামি করছ? তোমরা কি একেবারে দেশ ত্যাগ করে এসেছ নাকি?’