বিরক্ত ভরে মর্ডন্ট বলল–‘কিন্তু ক্রমওয়েল আমাকে ওই বন্দি দুজনকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই পাঠালেন।’
এটা গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিল দ্যার্তেগা, তবে সে জানে, ক্রমওয়েলের কোনো আগ্রহ এই বন্দিদের সম্পর্কে থাকতে পারে না, আগ্রহ থাকতে পারে এবং প্রবলভাবে রয়েছে ওই মর্ডন্টেরই, এখন সে যেন আকাশ থেকে পড়ল মর্ডন্টের কথা শুনে বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য? সে কি? ওরা তো আমাদের বন্দি, সব সভ্যদেশে এই নিয়ম যে যাকে বন্দি করেছে সেই বন্দির মালিক হবে। মহান ক্রমওয়েল, যার মতো বিজ্ঞ শাসক বা দক্ষ যোদ্ধা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই, তিনি কখনও ফরাসি দেশের বিশেষ রাজদূতদের ওপর এরকম অন্যায় আদেশ দিতে পারেন না।
‘অন্যায় আদেশ কিসে হলো?’ রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলেই তিনি এদের নিজের হেফাজতের ভেতরে এনে নিরাপদে রাখতে চাইছেন।
‘তা অবশ্য খুব স্বাভাবিক। মিষ্টি স্বরে বলে দ্যার্তেগা। কিন্তু কর্নেল আপনি তো বিবেচক লোক, আমরা গরিব মানুষ, আমাদের পাপ্য টাকাটা না পেলে আমরা কি করে বাঁচি? সৈনিক বৃত্তি গৌরব বৃত্তি হলেও সৈনিকদের আর্থিক দুরবস্থাও আপনার অজানা নেই, কারণ আপনি নিজে একজন বিখ্যাত সেনাপতি, আমাদের বন্দি দুজনকে আপনি নিয়ে যান তাতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু মুক্তিপণ দু’হাজার পাউন্ড আমরা পেতে চাই।’
‘বেশ পাবেন দু’হাজার পাউন্ড। আমি কথা দিচ্ছি, এখন লোক দুটোকে এনে দিন।’ মর্ডন্ট আর রাগ চেপে রাখতে পারে না।
‘আচ্ছা, কর্নেল এখনও তো মহান ক্রমওয়েলের লিখিত আদেশ পত্রটা দেখালেন না।’
‘লিখিত আদেশ?’–এবার সত্যি সংযম হারায় মর্ডন্ট—’আপনি কি আমার কথা অবিশ্বাস করছেন?’
জিভ কামড়ে সবেগে বারবার মাথা নাড়াতে লাগল দ্যার্তেগা এমন পাপ আমি করতে পারি? সব কাজেরই একটা রীতি পদ্ধতি আছে, এই বন্দিদের নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে–আপনিই তো বলছেন–সেক্ষেত্রে এদের যে আমরা আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি, মহান ক্রমওয়েলের আদেশ মতো তারও একটা দলিল থাকা চাই, না থাকলে, ভবিষ্যতে আমরা বেচারীরা শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়ে যেতে পারি। না, না, লিখিত আদেশ পত্র না পেলে আমরা বন্দিদের ছাড়তে পারি না।’
ক্রোধে গর্জন করে মর্ডন্ট বলে–‘আমি কেড়ে নিয়ে যাব ওদের, দেখছেন আমার সঙ্গে আটজন সৈনিক?’
‘এ হে হে হে।’ দ্যার্তেগা যেন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ে–‘আপনি কেন যে এমন অবুঝ হচ্ছেন, আদেশ পত্রটা নিয়ে আসেননি, নিয়ে আসুন গিয়ে, কতক্ষণের ব্যাপার আপনার জুলুমবাজি প্রতিরোধ করতে বাধ্য হব, লড়াই হবে, আপনারা নয়জন আছেন, আমরা মাত্র দুজন, সুতরাং আমরা মারা পড়ব সন্দেহ নেই। কিন্তু ফরাসি দেশ যে দেশের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করার জন্য আপনাকে যেতে হয়েছিল, প্যারিসে তার বন্ধুত্বের প্রতিদান আপনি যদি এভাবে দেন ফ্রান্সের রাজদূতের মস্থক কেটে ফেলে সেটা কি ম্যাজারিনই ভালো চোখে দেখবে–বোকা সে মোটেই নয়, দ্যার্তেগার কথায় সে মনে মনে স্বীকার করল, ঠাণ্ডা মেজাজে বলল–তাহলে এখানে আমার সৈনিকেরা রইল, আমি যাচ্ছি। আধঘন্টার ভেতরেই নিয়ে আসি আদেশ পত্র।’
যোগ করে দেয়, দ্যার্তেগা। আর তার সঙ্গে দু হাজার পাউন্ড।
সে কথার উত্তর দেয় না মর্ডন্ট, দুর্গের দিকে সে তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর ঢুকে যায় দ্যার্তেগা, সারাবাড়িটা ঘিরে বসে থাকে আট জন সৈনিক, সতর্ক প্রহরায়।
ভেতরে বসেই, অ্যাথোস কান পেতে শুনেছে।
অ্যারামিস বলে, ‘মর্ডন্টের মতলবটা পরিষ্কার, বেথুনের ঘাতকের কাছেই আমাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
অ্যাথোস জিজ্ঞাসা করে দ্যার্তেগাকে–‘পালাবার উপায় কিছু আছে নাকি?’
‘আছে বইকি? বজ্জাতি বুদ্ধি মর্ডন্টের একচেটিয়া নয়। দ্যার্তেগাও শিশু নয়, আমি একবার আস্তাবল ঘুরেয়ে আসছি।’
আস্তাবলে গিয়ে চাকরদের ডাক দিল দ্যার্তেগা, মস্কটন আর তার পোর্থসের সঙ্গেই এসেছিল, মিড আর ব্রেইসিরস ছিল অ্যাথোসের সঙ্গে রাজ শিবিরে যুদ্ধের পরে তারা এখানে এসে অ্যাথোসের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
প্রহরী সৈনিকদের শুনিয়ে শুনিয়ে জোর গলায়, দ্যার্তেগা বলতে থাকে। মাস্কেটন। গ্রিমড। ব্রেইসিরস! খুব ভালোই হয়েছে। বন্দিদের বাড়ি থেকে কবে মুক্তিপন আসত, কিছু ঠিক ছিল না, এখন আর তার জন্য আমাদের হাঁ করে বসে থাকতে হবে না, কর্নেল মর্ডন্ট নিজে আমাদের দুই হাজার পাউন্ড দিয়ে দিচ্ছেন, তিনি এখনি টাকাটা এনে দিবেন, টাকাটা পাওয়া মাত্র আমরা নিজের দেশের পথ ধরব। ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাইয়ে এক্ষুণি সাজিয়ে নিয়ে এস বাইরে। বন্দিদের ঘোড়া দুটোও আনো। কারণ তারাও যাবেন কর্নেল মর্ডন্টের সঙ্গে, একসাথে বেরুবো সবাই।
তারপর দ্যার্তেগা আবার ঘরের ভেতর এল, চুপি চুপি বলল–‘এক্ষুণি ঘোড়া নিয়ে চাকরেরা বাইরের দরজায় আসবে, তোমরা তৈরি হয়ে থাক, অ্যাথোস আর অ্যারামিস আবার তরোয়াল বেঁধে নাও। আমি বাইরে যাচ্ছি, যখন শুনবে আমি ‘ঈশ্বর রক্ষা কর’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছি, তখন তোমরা একসাধে ছুটে বেরুবে।’
আবার আস্তাবলে ঢুকল দ্যার্তেগা, প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল, আর দেরি করা চলে না। কর্মচারীরা প্রস্তুত। দ্যার্তেগার ইশারায় তারা ছয়টা ঘোড়া সাজিয়ে নিয়ে দরজার সামনে অপেক্ষা করতে লাগল। তিনটিতে তারা চড়ে রয়েছে। অন্য তিনটির লাগাম হাতে ধরা। আস্তাবলে শুধু দ্যার্তেগা আর তার নিজের ঘোড়াটি, প্রহরী সৈনিকদের ঘোড়াগুলোকেও তারা এখানে অবশ্য বেঁধে রেখেছে।