‘কার হাতে তরোয়াল তুলে দিলেন?’ প্রশ্ন ক্রমওয়েলের।
‘কারও হাতেই না, হাঁটুতে রেখে ভেঙে ফেলে দিলেন।’
‘তা খারাপ করেননি, তবে না ভেঙে ওটা নিজের উপকারে লাগাতে পারতেন। আর সেটি করলেই সকলের পক্ষে ভালো হত।’
মর্ডন্ট বলল—’আপনি বলতে চাইছেন–রাজা নিজের বুকে বসিয়ে দিতে পারতেন ওটা।’
এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ক্রমওয়েল জিজ্ঞাসা করলেন–‘আর কোনো বিশেষ ব্যক্তি মারা গেছেন?’
‘লর্ড উইন্টার।’
‘লর্ড উইন্টার? তোমার কাকা?’ ও মর্ডন্টের এই বলে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন ক্রমওয়েল-দিকে।
‘আমার চাচা বলেও তাকে আমি রেহাই দিতে পারি না, সে যখন পার্লামেন্টের শত্রু।’
‘তা তো বটেই।’ মাথা নাড়েন ক্রমওয়েল।
মর্ডন্ট হঠাৎ বলে—’মালিকের কাছে একটা প্রার্থনা আছে আমার। চার্লস স্টুয়ার্টের দলে শেষ সময়ে দুজন ফরাসি নাইট এসে যোগ দিয়েছিল। আমার কাকা এনেছিল তাঁদের ফ্রান্স থেকে, তারা আজকের যুদ্ধে বন্দি হয়েছে। ওই বন্দি দুজনকে আমার হাতে ছেড়ে দিন, এই প্রার্থনা—’
‘কে তাদের বন্দি করল?’ ক্রমওয়েল একটু আপত্তি তুললেন। যে বন্দি করবে তার অধিকার থাকবে বন্দির ওপর, এ পুরান নিয়ম আমি পালটাই কী করে?
‘আপনার কাছে বিশেষ অনুগ্রহ চাইছি আমার এতদিনের সেবার বিনিময়ে।’
‘ওরা খুব ধনী বুঝি? মোটা রকম মুক্তিপণ পাবার আশা করছ?’ ক্রমওয়েলের মুখে পরিহাসের হাসি।
‘ঠিক ধরেছেন–আমি যে গরীব তা তো জানেনই।’
‘বিশেষ অনুগ্রহ হিসাবে এইটিই যখন তুমি প্রার্থনা করছ এও সত্য যে তুমি কখনও কিছু চাওনি-বেশ, নিতে পার তুমি বন্দি দুজনকে যা ইচ্ছা করতে পার তাদের নিয়ে।’
‘যা ইচ্ছা করতে পার’–কথাটার ওপর একটি বেশি জোর দিয়ে রহস্যপূর্ণ চোখে ক্রমওয়েল একবার চাইলেন মর্ডন্টের দিকে, কি সে করতে চায় তা অনুমান করতে পেরেছেন তিনি। মর্ডন্ট ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল।
আসল কথা হলো প্যারিসে যখন সে ছিল, উইন্টারের চলাফেরার ওপর তীক্ষ্ণ চোখ সে রেখেছিল। উইন্টারের সঙ্গে দেখেছে অ্যাথোসকে, খোঁজ নিয়ে নামও জেনেছে তার।
আবার তার আগে বেথুনের ঘাতকের স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গে জেনেছে তার মায়ের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে উদ্যোক্তা ছিল অ্যাথোস, পোর্থস, অ্যারমিস ও দ্যার্তেগা নামের চার ফরাসি সৈনিক।
এখন সেই অ্যাথোসকে সে দেখেছে তারই অধীনে দ্যার্তেগার বন্দিরূপে। চিনেছে অ্যাথোসকে। মায়ের হত্যাকারী বলেই চিনেছে, প্রতিহিংসা নেবার এই সুযোগ, তারই জন্য বন্দিদের নিজের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসার এই প্রয়াস।
অ্যারামিস, পোর্থস বা দ্যার্তেগাকে প্যারিসে দেখেনি–তাদের নামও জানে না এখন পর্যন্ত, ম্যাজরিন যখন দ্যার্তেগা আর পোর্থকে ক্রমওয়েলের সেবা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন মর্ডন্টের কাছে, দ্যার্তেগাও ভবিষ্যতের কথা ভেবে জটিলতা এড়িয়ে চলার পথ খোলা রাখার জন্য ছদ্ম নামে নিজের ও পোর্থসের পরিচয় দিয়েছে।
কাজেই মর্ডন্ট মায়ের হত্যাকারী বলে নিঃসন্দেহে চিনেছে এবং অ্যাথোসকেই তার সঙ্গী বন্দি হয়তো পোর্থর্স বা অ্যারামিস বা দ্যার্তেগা হতেও পারে। কাজেই সঠিক চিনতে না পেরেও তাকে অ্যাথোসের সঙ্গে যমালয়ে পাঠাতে সে রাজী, কিন্তু দ্যার্তেগা ভাবে পোর্থসকে সে সন্দেহ করে না, ওরা যে মিল্যাডির হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, এমন কথা তার মাথায় খেলেনি।
আটজন সৈন্য নিয়েই সে বেরুলো, দ্যার্তেগা পোর্থসের জন্য নিউক্যাসেল শহরে একটি বাসস্থান দিয়েছেন ক্রমওয়েল। এটা শুধু ম্যাজারিনের দূতকে সম্মান দেখানোর জন্য।
এই বাসস্থানেই তারা বন্দি অ্যাথোস আর অ্যারামিসকে এনে তুলেছে, ঘরের ভেতর বসে চার বন্ধুতে আলোচনা হচ্ছে। অ্যাথোস বলছে, রানী হেনরিয়াটার অনুরোধে কীভাবে তাকে ও অ্যারামিসকে চলে আসতে হয়েছিল লর্ড উইন্টারের সঙ্গে, রাজা চার্লসের বিপদের দিনে তার সাহায্যের জন্যে, এদিকে দ্যার্তেগা জানাচ্ছে ম্যাজারিন কীভাবে ক্রমওয়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ঘনিষ্ট করে তুলার জন্য তাকে ও পোর্থসকে পাঠিয়েছিলেন মর্ডন্টের কাছে, বিশেষ রাজদূতের মর্যাদা দিয়ে। অ্যাথোস জিজ্ঞাসা করে ‘তোমাদেরকে মর্ডন্ট চেনে?’
‘বোধহয় না, কিন্তু আমরা তাকে চিনি, মর্ডন্টের নাম আমাদেরকে গ্রিমড জানিয়েছে। উত্তর দিল দ্যার্তেগা।
পোর্থস ক্ষোভের সঙ্গে জানাল–‘লোকটাকে দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে, গলাটা চেপে ধরে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে, অথচ ভাগ্যের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে এই মর্ডন্ট হয়েছে কর্নেল, আর আমরা যেহেতু অলস হয়ে বসে না থেকে যুদ্ধ করতে চেয়েছি, কাজেই আমরা কর্নেল মর্ডন্টের অধীনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। এ জানলে যুদ্ধ করার কথা মুখেও আনতাম না।’
ঠাট্টা করে অ্যারামিস বলল–‘আরে ভাই, যুদ্ধ করতে চেয়েছিলে বলে আমাদের প্রাণটা বাঁচাতে পারলে, বিশেষ রাজদূত সেজে চেয়ারে বসে থাকলে আমরা এতক্ষণে…’ খটাখট, খটাখট, অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের শব্দে কথা থেমে গেল তার।
লাফিয়ে উঠে দরজার বাইরে চলে দ্যার্তেগা।
ঘোড়া থেকে নামছে মর্ডন্ট, বেশ খুশী দ্যার্তেগা–‘আরে কর্নেল, ডিনারটা কি দয়া নামী দামি লোক,’ একটু হেসে গলা নামিয়ে দ্যার্তেগা আবার বলে, ‘মোটা দাও মিলে গেছে কর্নেল, এক একজন এক এক হাজার। পাউন্ড মুক্তিপণ তো দেবেই।‘