‘চিনার কথা তো, ওই হলো ক্রমওয়েল’, একটু হেসে রাজা বললেন। পিছনে একটি ছোট সৈন্যদল নিয়ে উইন্টার এসে পড়লেন। ছোট হলেও এই চারশো অশ্বারোহী যদি তাদের কর্তব্য ঠিকমতো করে, তাহলে এখনও আশা আছে।
এতক্ষণে স্কট সৈন্যরাও জোট বেধে মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে, উইন্টার ইংরেজ সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে দেখে তাদের অনেকের লজ্জা হলো, তবে তারা কেউ নেতা নয়, ঘটনার গতি পালটে দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই তারা শুধু লাইন ছেড়ে বেড়িয়ে এল। আর হাঁটুতে চাপ দিয়ে যার যার তরোয়াল দু টুকরো করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
এ দৃশ্য দেখে রাজার বিষন্দু মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। উইন্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘সবাই ওরা বিশ্বাসঘাতক নয়, দেখছ? সময়ের চাপে পড়ে ওদের রাজদ্রোহীদের দলে মিশতে হয়েছে, যাই হোক আর দেরি করার প্রয়োজন নেই। উইন্টার তোমার সৈনিকেরা সামনে এগোক। এবার আমাদের ওই ফরাসি বন্ধুদের সম্মানে ফরাসি জাতির জয়ধ্বনিই আমরা উচ্চারণ করি এসো-মন্টজয় এবং সেন্ট ডেনিস, ইংল্যান্ডের জাতীয় জয়ধ্বনি ‘সেন্ট জর্জ ফর ইংল্যান্ড’ তো এখন বিদ্রোহীদের গলায় উচ্চারিত হচ্ছে।’
উইন্টার আদেশ দিলেন–‘খোলা তরোয়াল, মন্টজয়ে এন্ড ডেনিস, মন্টজয় এন্ড সেন্ট ডেনিস।’ ধ্বনিত হল চারশো কণ্ঠে, চারশো তরবারি ঝিলিক দিয়ে উঠল ভোরের সূর্যের আলোয়।
‘সামনে এগোও’–দ্বিতীয় আদেশ এল।
কিন্তু কোথায়? অশ্বারোহী সৈন্য দল পাথরের মসর্তির মতো অচল।
অ্যারামিসের কানে কানে অ্যাথোস বলল–‘ওই দেখ বিশ্বাসঘাতকতা কাকে বলে,’ ততক্ষণে রাজা চমকে ফিরে দাঁড়িয়েছেন, উইন্টার ক্ষুব্ধ ও ক্রুব্ধ স্বরে গর্জন করে উঠেছেন–‘যারা ভগবানকে ভালবাস দেশকে ভালোবাস, রাজাকে যারা ঈশ্বরের এবং পিতৃভূমির জীবন্ত প্রতিনিধি বলে মানো, এগিয়ে যাও তারা।’
এবারে তারা এগিয়ে গেল, কিন্তু সারি বেধে না, একদিকেও না, যে। যেভাবে খুশি ঘোড়া ছুটিয়ে এক একজন বিস্তীর্ণ মাঠের এক একদিকে হাওয়ার মতো উধাও হলো, সেনাপতির আদেশ যাতে আর কানে না যেতে পারে সেইজন্য।
উইন্টারের পায়ের নিচে থেকে মাটি যেন সরে গেল, ‘বেঈমান’ একটা চাপা গর্জন ছাড়া তার মুখ থেকে আর কোনো কথাই বেরুলো না। অ্যাথোস লক্ষ্য করল–মাত্র পনেরোজন অশ্বারোহী তখনও উইন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজা তরোয়াল ঘুরিয়ে চিৎকার করে বললেন–‘কিছু যায় আসে না। সংখ্যা যত কম হবে, গৌরব তত বেশি হবে, ওই আসছে ক্রমওয়েলের সৈন্য, বন্ধুগণ ওই সৈন্যদের ভিতর দিয়ে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে।’
তখন অ্যাথোস, অ্যারামিস আর উইন্টারের অনুসারী ১৫ জন বিশ্বস্ত সৈনিক, মোট আঠারজন যোদ্ধা রাজা চার্লসকে চারদিক থেকে ঘিরে দাঁড়াল এবং উইন্টারের আদেশে আঠারজন অশ্বারোহীর সেই দল একটা সুচের মতো ছুটে গেল শত্রু সৈন্যের উদ্দেশ্যে। তীব্রগতি, প্রচণ্ড আঘাত, ঘোড়ার
ডাক, রক্তমাখা তরোয়ালের ঝলকানি, একটা গুলি এসে লাগল উইন্টারের বুকে, একটা হাসির শব্দ শোনা গেল শত্রুসৈন্যের পিছন থেকে।
উইন্টার ঘোড়া থেকে পড়তে পড়তেও লক্ষ্য করলেন তার আততায়ী সেই মর্ডন্ট, মিল্যাডির ছেলে।
একদিকে সতেরোজন যোদ্ধা অন্যদিকে সতেরো শত। একটা বীভৎস হত্যাকাণ্ড চলছে রাজার চারপাশে, অ্যাথোস আর অ্যারামিসকে ধরাশায়ী করার জন্য তরবারি উঠছে অনেক, কিন্তু রাজার গায়ে কেউ আঘাতের চেষ্টা করছে না, রাজা বুঝলেন ওরা তাকে বন্দি করতে চায়, কিন্তু তা তিনি হতে দেবেন না, মৃত্যুকেই বরং বেছে নেবেন, যেমন করে বেছে নিয়েছেন তার শেষ ইংরেজ বন্ধু উইন্টার। তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে একবার এ সৈনিকের কাছে আবার ঘোড়া ছুটিয়ে ও সৈনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে লাগলেন হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে, কিন্তু না, কেউ তার সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, প্রত্যেকেই সরে যাচ্ছে তার সামনে থেকে।
কিন্তু অন্যরকম অবস্থা অ্যাথোস আর অ্যারামিসের। প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়েও এই দুই যোদ্ধা আর বুঝি নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। মৃত্যু তাদের এগিয়ে আসছে। ওই শত্রুর তরবারি নামছে।
হঠাৎ বিদ্যুতের বেগে দুটো প্রকাণ্ড ঘোড়া শত্রু সৈন্যের পিছন থেকে সামনে ছুটে এলো নিজের দলের সৈন্যদের চাপা দিয়ে। অ্যাথোস ও অ্যারামিসকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে হটিয়ে দিল, তারপর একজনে অ্যাথোসকে, হামলাকারীদের অ্যারামিসের ঘোড়ার লাগাম ধরে সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল ‘আত্মসমর্পণ কর। আত্মসমর্পণ কর। নিচু গলায় বলল–‘আমায় চিনতে পারছ না?
হুশ ফিরে পেয়ে অ্যাথোস সবিস্ময়ে বলল–‘দ্যার্তেগা!’
অ্যারামিস বলল–‘পোর্থস!’
তারা দুজনেই শুধু বলল–‘চুপ আমরা তোমাদের অপরিচিত।’
.
৬.
দুই ঘণ্টা পরে।
নিউক্যাসল দুর্গের একটি রুমে ক্রমওয়েল বসে যুদ্ধের বিবরণ শুনছেন। বিবরণ দিচ্ছে সেই মর্ডন্ট।
আক্রমণের আদেশ দিয়ে ক্রমওয়েল অন্য কাজে চলে যেতে বাধ্য। হয়েছিলেন, যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। রাজা হয় বন্দি হবেন না হলে মারা যাবেন এই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন তিনি। কাজেই নিজে যুদ্ধের শেষ দেখার জন্য উপস্থিত থাকার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি।
তাই মর্ডন্ট সব কথা তাকে শোনাচ্ছে।
‘রাজা আত্মসমর্পণ করেছেন।’