‘উইন্টার। তোমার অল্প ইংরেজ সেন্য তারা—’
‘তাদের বিশ্বস্ততার জন্য আমি জামিন, রাজা।
‘তাহলে চলো, সেই কয়েকজন সৈনিককে নিয়ে আমরা স্কটল্যান্ডের ভেতরে যাই। যেখানে রাজদ্রোহ এখনও ব্যাপকভাবে দেখা দেয়নি। সেখানে যদি নতুন সৈন্যদল গড়তে পারি তো ভালোই, যদি না পারি স্কটল্যান্ড পার হয়ে, সমুদ্র পার হয়ে নরওয়েতে চলে যাব–যেখানে বন্ধু মন্টরোজকে আগেই আশ্রয় নিতে হয়েছে।’
রাজা তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ পোশাক পড়ে নিলেন, তারপর উইন্টার, অ্যাথোস ও অ্যারামিসকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তাবু থেকে।
উইন্টার চলে গেল তার ইংরেজ সেন্যদের দলটিকে নিয়ে আসার জন্য। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটছে, রাজা উত্তর পশ্চিম দিকে তাকালেন, ওই দিকেই হাইল্যান্ডে যাওয়ার রাস্তা। ওই রাস্তাই তাকে ধরতে হবে, একটা জমাট কালো বিস্তৃত পদার্থ। কী ওটা? সারা উত্তর পশ্চিম দিকটাকেই আটকে রেখেছে? কুয়াশা?
অ্যাথোস ও অ্যারামিস লক্ষ্য করল কালো রেখাটাকে। অ্যাথোন চারদিকে তাকাল না, কুয়াশা তো অন্য কোথাও নেই! সে কাঁপা গলায় বলল—’মজারাজা আমাদের আর পালানো হলো না।’
‘হলো না? কেন?–রাজার মনেও যে একই সন্দেহ জেগেছে তা তার কণ্ঠের সুরেই ধরা পড়ে গেল।
‘হলো না কারণ, ওই কালো রেখাঁটি হচ্ছে ক্রমওয়েলের সৈন্যের দল আমাদের একমাত্র পালাবার পথ ওরা আটকে রেখেছে।’
নিজের মনের সন্দেহ অ্যাথোসের মুখ থেকে এভাবে মিলে যেতে দেখে রাজা বোধহয় ক্ষোভে রোষে মরিয়া হয়েই স্কচ সৈন্য শিবিরের দিকে ছুটলেন, বাধ্য হয়েই অ্যাথোস ও অ্যারামিসকেও ছুটতে হল তার সঙ্গে।
পথে তারা বারবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছেন, মহারাজা?’
‘আমি শুধু একটা মুখোমুখি বোঝাপড়া করতে চাই লেভেনের সঙ্গে।’
রাজাকে আটকানো গেল না, তখনও সেই চক্রান্তকারী সৈন্য সামন্তরা জটলা করছে লেভেনের তাবুতে। রাজাকে হঠাৎ তাবুর মধ্যে উপস্থিত হতে দেখে কয়েকজন সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রাজা, রাজা’।
লর্ড লেভেন সচকিত হয়ে উঠলেন, ‘রাজা? এ সময়ে রাজা এখানে?’
রাজা ততক্ষণে একেবারে তাবুর মধ্যে ঢুকে পড়েছেন, তিক্তস্বরে তিনি বললেন–‘হ্যাঁ, রাজা। যে রাজাকে তোমরা দুই লক্ষ পাউন্ডে ক্রমওয়েলের কাছে বিক্রি করেছ, সেই রাজাই বটে আমি।’
আকাশ থেকে পড়লেন লেভেন–এ খবর রাজার কানে এর মধ্যে পৌঁছে গেল কীভাবে ভেবে পেলেন না কিছুতেই, ঢোক গিলে আমতা আমতা করে কোনো মতে বললেন, কি যে বলেন, মহারাজা। আমরা যে প্রত্যেকে রাজার জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত, তার যে কোনো প্রমাণ আমরা দিতে পারি।
রাজা বললেন, আমি একটাই মাত্র প্রমাণ চাই লেভেন, এই মুহূর্তে ক্রমওয়েলের সৈন্যকে আক্রমণ কর। তাতেই তোমার কথার সত্যতা প্রমাণ হবে, লেভেন মাথা নিচু করে বলেন–‘রাজা জানেন যে সেটা অসম্ভব। কারণ ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ বিরতির চুক্তি রয়েছে।’
‘কিন্তু ওদের সৈন্য আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। তাকে কি চুক্তির বরখেলাপ হয়নি?’
‘কে বলল যে ওরা ক্রমওয়েলের সৈন্য?’
‘কাউকে বলতে হয়নি, আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি, রাত্রি জেগে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে ব্যস্ত না থাকলে তোমরাও দেখতে পেতে।’
আর কথা যোগাল না লেভেনের মুখে।
তখন সামনে এগিয়ে এল কয়েকজন দুঃসাহসী পাহাড়ি সামন্ত, নীচ লোকদের স্বভাবই এই যে তাদের নিচুতা যখন ধরা পড়ে যায়, তখন তারা লজ্জা ঢাকতে যায় ঔদ্ধাত্ব এবং স্পর্ধার দ্বারা। এরাও তাই করল—’হ্যাঁ, ষড়যন্ত্র করেছি, করব না কেন? অত্যাচারী শোষণকারী চার্লস স্টুয়ার্টের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছি। আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে। আর তোমাকে তাবুর বাইরে যেতে হবে না। চার্লস স্টুয়ার্ট, তোমাকে আমরা বন্দি করলাম।’
এই বলে সত্যি সত্যি দুই দুবৃত্ত দুই দিক থেকে হাত বাড়াল রাজার দুই হাত ধরার জন্য। অমনি বিদ্যুতের ঝলকের মতো বেরিয়ে এল দুটি তরবারি, আর আমূল ঢুকে গেল তাদের বুকে। অ্যাথোস আর অ্যারামিস অকারণে আসেনি রাজার সঙ্গে।
অপ্রত্যাশিতভাবে দুজন অপরিচিত যোদ্ধাকে হঠাৎ রাজার সাহায্যে উপস্থিত হতে দেখে রাজদ্রোহীরা ভয় পেয়ে গেল। অপরিচিত যোদ্ধারা বেপরোয়া এবং মরিয়া। বিনা বাক্য ব্যয়ে দুই জনকে তারা পরলোকে পাঠিয়েছে চোখের পলকে। পরের বার যারা রাজাকে বন্দি করতে যাবে তারাও হয়তো একই পথের পথিক হবে। এ অবস্থায় হঠাৎ আর কেউ এগিয়ে এল না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আক্রমণের একটা ধারা আগে স্থির করে নিতে চায়। এদিকে অ্যাথোস আর অ্যারামিস দাঁড়িয়ে নেই। রাজাকে মাঝখানে নিয়ে তারা দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে, তাবু থেকে বেরিয়ে পড়তে আর কতক্ষণ লাগবে তাদের? অচিরেই খোলা মাঠে এসে পড়ল তারা রাজাকে নিয়ে।
রাজদ্রোহীরা পিছু ধাওয়া করেনি। লেখেন তাদের বুঝিয়েছে, যাক না রাজা কোথায় যাবে, চারিদিকের পথঘাট বন্ধ। তোমরা সজ্জিত হয়ে নাও। সুশৃঙ্খল ভাবে সামনে এগোও। ক্রমওয়েল যেন আমাদের এলোমেলো হাটুরও জনতা বলে ভুল না করে।
উইন্টার এখনও আসছে না, একজন তার খোঁজ করতে যাবে কিনা ভাবছে। এমন সময় অ্যাথোসের দৃষ্টি পড়ল–শীর্ণ নদীটির ওপারে পিলার উপর সৈন্য পরিবেষ্টিত একজন বেঁটে মোটা লোক চোখে দূরবীন তুলে তাদের তিন জনকে দেখছে, রাজাকে সে জিজ্ঞেস করল–‘রাজা কি ওই লোকটাকে চেনেন?’