দ্যার্তেগা পোর্থসের কথা বাদ দিয়ে এবার দেখা যাক কোথায় আছে অ্যাথোস আর অ্যারামিস।
পাহাড়ি এলাকা স্কটল্যান্ডের ছোট শহর সাজেল নিউক্যাসল। অবশ্য শহর ছোট হলেও এতে একটা দুর্গ আছে এবং দুদিন আগেও সেই দুর্গের মাথায় উড়ছিল ইংল্যান্ডের রাজার বিজয় পতাকা।
রাজার পতাকা কাল থেকে নেমে গেছে, সেখানে উড়ছে বিদ্রোহী ক্রমওয়েলের পতাকা, বাধ্য হয়ে রাজা দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে এসেছে খোলা জায়গায় কয়েকজন সেনৗ এখনও সঙ্গে আছে, তারা আশ্বাস দিয়েছে, পরের যুদ্ধেই তারা শেষ করে দিতে পারবে ক্রমওয়েলের শক্তি, কারণ পাহাড়ি এলাকা থেকে রাজার সামন্তেরা সদল বলে আসছে রাজার সেবা করার পবিত্র দায়িত্ব মাথায় তুলে নেয়ার জন্য।
শহরের নিচে সরু এক নদী, তার এপারে উঁচু নিচু একটি জায়গা, সেখানে অল্প কয়েকটি তাবু। সবচেয়ে বড় যে তাবুটা সেখানে এই শেষ রাত্রেও একটা প্রচণ্ড ঝগড়া ঝাটি বলছে, সেখানে উপস্থিত আছেন সীমান্ত অঞ্চলের সব সামন্ত সর্দার। সভাপতির আসনে আছেন লর্ড লেভেন, কারণ রাজার সৈন্যের তিনিই সেনাপতি।
তাবুটার আশেপাশে পাহারা রয়েছে, যাতে বাইরের কেউ এসে এই বাদানুবাদের একটি কথাও শুনতে না পায়, কিন্তু পাহারাদারদের চোখে ফাঁকি দিয়ে একটি লোক তাবুর বাইরে শুয়ে আছে, একেবারে তাবুর কাপড়ের সাথে শরীর মিশিয়ে। ভেতরে যেসব কথা হচ্ছে, তার কান এড়িয়ে যাচ্ছে না কোনো কিছুই।
লর্ড লেভেন বলে উঠলেন, ‘এই তাহলে ঠিক হল?’
‘নিশ্চয়ই’–সমস্বরে বলে উঠল সমবেত সামন্তেরা।
আর অপেক্ষা করল না, বাইরে আত্মগোপনকারী ব্যাক্তি, হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে গেল, এভাবে তাকে অনেক দূর আসতে হলো, অবশেষে একটা উঁচু ঢিবি পাওয়া গেল, একজন সৈনিক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে তার আড়ালে ঢিবির সাথে গা মিশিয়ে। এবার উঠে দাঁড়াল হামাগুড়ি দেয়া লোকটিও। তারপর আস্তে আস্তে কথা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে তারা এগিয়ে গেল অন্য দিকে। সেখানে রাজার শিবির ঘিরে রয়েছে অল্প কয়েকজন ইংরেজ সৈনিক।
গুপ্তচর দুজন ঢুকে পড়ল রাজার তাবুর পাশের তাবুতে। সেখানে তখনও পায়চারি করছেন অস্থিরভাবে লর্ড উইন্টার, তার চোখে ঘুম নেই, এই গুপ্তচর দুজন যে অ্যাথোস ও অ্যারামিস তা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝতে পারছেন,–‘লর্ড উইন্টার, এই মুহূর্তে রাজার সাথে আমাদের দেখা হওয়া দরকার, অ্যাথোস জানাল।’
দুঃখের সাথে জানালেন উইন্টার রাজা বিশ্রাম নিচ্ছেন। ‘এখন তাকে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? এ মুহূর্তে রাজাকে না তুললে আর জীবিত অবস্থায় হয়তো তোলা যাবে না।’ বলল অ্যাথোস।
একথা শুনে তবে চুলুন–‘বলে দুজনকে তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন।’
রাজার তাবুতে যাওয়ার একটা পথ উইন্টারের তাবুর ভেতর দিয়েই, ঢাকা এবং সুরক্ষিত। তিনজনে আধা মিনিটের ভেতর রাজার শোবার ঘরে উপস্থিত হলেন। ঘরে কোনো আসবাব নেই। ইংল্যান্ডেরা রাজা চার্লস শুয়ে আছেন, একটা সরু খাঁটিয়ার উপরে। দুটি মাত্র মোমবাতির আলোতে তাবুর ভেতরের অন্ধকার দূর হয়েছে সামান্যই।
শোবার আগে রাজা পোষাক পর্যন্ত খোলেননি, যুদ্ধের পোষাক পরেই সারা দিনের পর শুয়েছেন। ঘুমে ঢলে পড়েছে শ্রান্ত শরীর। কিন্তু শান্তি পায়নি মন, মাথার বালিশে দুই ফোঁটা চোখের জলই যে তার সাক্ষি বন্ধ দু চোখের কোনো থেকে আস্তে আস্তে জেগে উঠলেন রাজা নিজেই।
রাজা আস্তে আস্তে পরিস্থিতিটা বুঝে নিলেন। শান্ত স্বরে বললেন–‘প্রিয় উইন্টার আরো প্রিয় আমার নতুন বিদেশী বন্ধুদ্বয়। বিপদ নিশ্চয়ই আগের চাইতে গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে?–তা নইলে তোমরা এই শেষ রাতে আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত করতে ছুটে আসতে না।’
মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে অ্যাথোস বলল—’মহারাজ, বিপদ সত্যিই গুরুতর। এই মুহূর্তে না পালালে পালাবার পথও বন্ধ হয়ে যাবে।’
রাজা অবাক হয়ে বললেন–‘পালাব কেন? এখানে আমার সৈন্যবল অল্প হলেও আত্মরক্ষার জন্য যথেষ্ট। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সাহায্য আসবে, সেনাপতি লেভেন আমাকে কথা দিয়েছেন যে–’
‘আপনাকে লর্ড লেভেন যে কথা দিয়েছেন রাজা, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এইমাত্র তারই সভাপতিত্বে এক সভায় সৈনিক এবং সামন্তেরা স্থির করেছেন যে—’
‘কী, কী স্থির করেছে তারা?’–ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করলেন রাজা, অ্যাথোসকে হঠাৎ থেমে যেতে দেখে।
অ্যাথোস সরাসরি উত্তর দিতে পারল না ঘুরিয়ে জানতে চাইল—’স্কচ সৈনিকদের বেতন কি কিছু বাকী আছে রাজা?’
‘তা আছে। গত দুই বছর আমার সাহসী সৈন্যরা রক্তের বিনিময়ে গৌরব ছাড়া আর কিছুই পায়নি।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাজা।
অ্যাথোস মাথা নেড়ে বলল–‘সেজন্যই, তাদের পাওনা আছে চার লক্ষ পাউন্ড। দুই লক্ষ পাউন্ড তারা আজই আদায় করবে-অর্থাৎ ক্রমওয়েলের কাছ থেকে পুরুস্কার পাবে।’
‘পুরস্কার পাবে? মানে?’ রাজা যেন বিভীষিকা দেখছেন?
‘পুরস্কার পাবে আপনাকে ক্রমওয়েলের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে। সোজা কথা দুই লক্ষ পাউন্ড মূল্যে ওরা রাজাকে বিক্রি করেছে শত্রুর কাছে।’
এক মুহূর্ত নীরব রাজা, চেষ্টা করেও কথা বলতে পারছেন না, অবশেষে তিনি থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন–‘কাউন্ট। এ খবরে কোনো ভুল নেই তো?’
‘আমি নিজের কানে শুনেছি প্রত্যেকটি কথা, নিজের চোখে দেখেছি প্রতিটি রাজদ্রোহী সৈনিককে।’