দ্যার্তেগার অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য আজ আবার নতুন করে রানীর অন্তর শ্রদ্ধায় পূর্ণ হয়ে উঠল, রাজার কানে কানে বললেন–লেফটেন্যান্টকে একটা ধন্যবাদ দাও। ওই লোকটিই আজ আমাদের রক্ষা করেছে।
আস্তে আস্তে ফ্রান্সের রাজভক্ত অভিজাতেরা একে একে সেন্ট জার্মেইন এসে পৌঁছতে লাগলেন, প্রিন্স এবং ডিউকেরা বাদ রইলেন না কেউ, রানী তাদের আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।
এলেন তো সবাই। কিন্তু ঘুমাবেন কোথায়? শীতের রাত্রি, সেন্ট জার্মেইনের ছোট সরকারী বাড়িটিতে বিছানা মাত্র তিনটি, একটিতে রানী, একটাতে রাজা এবং অন্যটাতে রাজার চাচা প্রিন্স অব অর্ণিয়।
দ্যার্তেগা আগে থাকতেই অনুমান করেছিল যে বিছানার অভাবে আজ এই অভিজাত ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাদের না ঘুমিয়ে বসে বসে রাত কাটাতে হবে, তাদের এই দুর্যোগ থেকে নিজের জন্য কিছু সুযোগ করে নেয়ার চেষ্ট সে করবে না কেন? পোর্থসকে নিয়ে সমস্ত শহর একবার টহল দিয়ে এসেছে এবং শহরের সমস্ত খড় কিনে এনেছে রেখেছে মস্কেটনের কাছে–এক আটির দাম এক স্বর্ণ মুদ্রা। যে কিনতে আসবে, ওই দামই দিতে হবে তাকে।
তারপর প্রিন্স আর ডিউকদের সামনে বসে নিজের জন্য একটি খড়ের বিছানা তৈরি করতে বসল, প্রিন্স ডিউক এবং তাদের স্ত্রীরা তখন বসে হি হি করে কাঁপছেন শীতে, কোথায় পেলেন খড়? কোথায় পেলেন? জিজ্ঞেস করল সবাই। সেই রাত্রে খড় বিক্রি করে চারশো লুই লাভ করল দ্যার্তেগা আর পোর্থস। মস্কেটন দশ বিশ লুই চুরি করেছিল, সেটা বাদ দিয়েই।
৫. খড়ের বিছানা
৫.
দ্যার্তেগা সবেমাত্র নিজের জন্য তৈরি করা এক হাত পুরু খড়ের বিছানায় শুয়ে গায়ের উপর চাদর টেনে দিয়েছে এমনি সময় পোর্থস মুখ কাচু মাচু করে এসে হাজির। ‘ও ভাই দ্যার্তেগা আমি এখন কোথায় শুই?’
দ্যার্তেগা কানের উপর চাদর টেনে নিয়ে ঘুম ঘুম ভাব করে জবাব দিল–‘কেন? মস্কেটন তোমার জন্য খড় রাখেনি?’
পোর্থস গর্জে ওঠে–‘হতভাগা শয়তানটা পয়সার লোভে সব খড় বেচে দিয়েছে আমার জন্য এক আঁটিও রাখেনি। আমাকে তোমার অর্ধেক খড় দাও।’
‘বিছানা তৈরি করার আগে যদি বলতে, তাহলে নিশ্চয়ই দিতাম, এখন এই তৈরি বিছানা ভাঙব কি করে? অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি।’
দ্যার্তেগাও বিছানা ভেঙে তা থেকে খড় দিতে রাজী হয় না, আর পোর্থস এরকম অবস্থা মেনে নিতে রাজী নয় যে দ্যার্তেগা আরামে নাক ডেকে ঘুমাবে আর সে বসে বসে শীতে হি হি করে কাঁপবে। শেষে একটা মীমাংসা হলো। পোর্থস দুই লুই দেবে দ্যাৰ্তেৰ্গাকে বদলে পোর্থসকে নিজের বিছানায় শুতে দেবে দ্যার্তেগা।
পোর্থসকে নগদ দুই লুই গুনে দিতে হলো।
তারপর দুজনে পাশাপাশি শুয়ে আবার চোখ বুজেছে, এমন সময় এক সৈনিক কর্মচারী এসে ডাকল—’লেফটেনান্ট দ্যার্তেগা এখানে আছেন?’
দ্যার্তেগা কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু পোর্থস লাফিয়ে উঠল, চটপট জবাব দিল—’এই যে এখানে শুয়ে আছে।’
‘ও এখানে শুয়ে আছে, লেফটেনান্ট আপনাকে এক্ষুণি ডাকছেন কার্ডিনাল ম্যাজারিন শিগগির আসুন।’
লাফিয়ে উঠল দ্যার্তেগা। নিশ্চয়ই এত রাত্রে ডেকে তাকে ক্যাপটেন পদ এবং পোর্থসকে ব্যারণ উপাধি দেবে না, ম্যাজারিনের কৃতজ্ঞতা নেই এমন কথা কে বলবে?
কোমরের বেল্টে তরোয়াল ঝোলাতে ঝোলাতে দ্রুতপায়ে হাঁটছে দ্যার্তেগা, এদিকে বিছানার মাঝখানে এসে আরাম করে হাত পা ছাড়িয়ে শুয়ে পড়ল পোর্থস।
দ্যার্তেগা গিয়ে সালাম দিতেই ম্যাজারিন একখানি খাম এগিয়ে দিলেন। তার দিকে-এই মুহূর্তে লন্ডন যাত্রা করতে হবে তোমাকে। বোলম বন্দরে মর্ডন্ট নামে এক যুবকের সঙ্গে দেখা করো। চিঠিটা তার হাতে দেবে এবং সে যেভাবে যা করতে বলে সেভাবেই সে কাজ করবে।
দ্যার্তেগা বেশ তিক্ততার সাথে প্রশ্ন করে, ‘আমাকে ক্যাপটেনের পদ আর আমার বন্ধুর ব্যারণ উপাধী’?
এসব হাঙ্গামা না হলে আজই ওটা হয়ে যেতে পাত, কিন্তু বুঝতে পারছ তো, রানীর মেজাজ এখন কীরকম? ধরে নাও ও তোমাদের হয়েই আছে, তোমরা ফিরে এলেই-হ্যাঁ তোমার বন্ধু ভ্যালনকে নিতে ভুলো না, তার উপর আমার অনেক ভরসা
দ্যার্তেগা এরপর প্রশ্ন করে, কিন্তু লন্ডনে যেতে হলে টাকার দরকার? খড় বিক্রির লাভের টাকা ম্যাজারিনের কাজে খরচ করতে দ্যার্তেগা রাজী নয়।
বাধ্য হয়ে ম্যাজারিনকে এক থলি স্বর্ণমুদ্রা বের করে দিতে হলো, তিনি মনে মনে মহা বিরক্ত। ওরা কাজ করছে বটে কিন্তু প্রতি কাজেই রক্ত শুষে নিচ্ছে, ম্যাজারিনের কাছে টাকাই হলো রক্ত।
থলেটা পকেটে নিয়ে দ্যার্তেগা বাইরে এল, বাইরে তখনও অপেক্ষা করছে সেই সৈনিক কর্মচারী, দ্যার্তেগা বলল–‘আমার বিছানায় মঁসিয়ে ভ্যালন শুয়ে আছেন, তাকে ডেকে দিন,’ দ্যার্তেগার সাথে আস্তাবলে দেখা করতে বলবেন।
বাতাসের বেগে দৌড়ে গেল সৈনিক। পোর্থসকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আস্তাবলে পাঠাতে বেশ পরিশ্রম করতে হলো তাকে কিন্তু কাজটা করার পর সৈনিক আর ম্যাজারিনের আদেশ শোনার জন্য তার কাছে ফিরে গেল না দ্যার্তেগা পোর্থসের ছেড়ে যাওয়া বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
সেন্ট জার্মেইনের রাজবাড়িতে সে রাত্রে একজন মাত্র লোক, যার কপালে বিনা পয়সায় বিছানা জুটেছে, না বললেও চলে, সে ঘুমালো খুব আরামে এবং আনন্দে।