একদল অস্ত্রধারী জনতা এসে গাড়ির পথ আটকাল, ‘কে যায় গাড়িতে?’
‘যায় ম্যাজারিন।’ হেসে জবাব দিল দ্যার্তেগা।
ভয়ে সজারুর কাঁটার মতো মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল ম্যাজারিনের। জনতা সত্য কথাটা তামাশা মনে করে রাস্তা ছেড়ে দিল।
গাড়ি প্রায় সেন্ট আনোর গেটের কাছে নিয়ে পৌঁছেছে, এই সময় আবার একদল জনতা এসে পথ আটকে দাঁড়াল, গাড়ি দেখব, দরজা খোল।
দ্যার্তেগা মুখ বের করে দেখল জনতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার এক সময়ের চাকর প্ল্যাঞ্চেট, যে এখন শহরের একজন নামকরা মিষ্টির ব্যবসায়ী, একটা দোকান এবং একটা বাড়ির মালিক, দ্যার্তেগা তার সব খবর রাখে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দ্যার্তেগা। আরে প্ল্যাঞ্চেট যে, আমাদের একটু তাড়াতাড়ি এগিয়ে দাও তো ভাই। পোর্থস ভীষণ আহত।
‘বলেন কি? মঁসিয়ে ড্যানস, আহত।’
‘ভাই প্ল্যাঞ্চেট এবার বোধহয় আর বাঁচব না, গুলিটা কাঁধের ভেতর দিয়ে পাজরায় ঢুকেছে,’ টেনে টেনে কাতরায় পোর্থস।
‘আহ্হা, এ অবস্থায় ওকে নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?’
তাড়াতাড়ি উত্তর দিল দ্যার্তেগা। নিয়ে যাচ্ছি পোর্থসের ব্রাশিওজের জমিদারীতে, নিজের বাড়িতে গিয়ে মরার জন্য জেদ করল, আর, লোকের শেষ ইচ্ছায় বাঁধা দেয়া উচিত নয়, আহা পোর্থসরে তুই না বাঁচলে আমি কি সেই শোক সইতে পারব।
প্ল্যাঞ্চেট হুকুম দিল—’এরা বন্ধু, গেট খুলে দাও।’
সেন্ট জার্মানের পথে গড় গড় করে চলে গেল সেন্ট আলোর গেট পেরিয়ে ম্যাজারিনের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল দ্যার্তেগা, এখানে আগে থেকে তোক দিয়ে নিজেরও পোর্থসের ঘোড়া পাঠিয়ে দিয়েছিল, একটু পরেই সেই ঘোড়া খুঁজে পাওয়া গেল, দ্যার্তেগা উঠল নিজের ঘোড়ায়। এবার সে রানীকে আনতে যাবে।
দ্যার্তেগাকে বিদায় দিয়ে ম্যাজারিন নিজের মনেই বলল, মাত্র একটা হীরের আংটি দিয়েছি ওকে, কিন্তু এ উপকারের প্রতিদানে হীরে দিয়ে ওজন করে সব হীরে দিয়ে দিলেও শোধ হয় না।
.
ম্যাজারিনের গার্ড হিসেবে যেতে হয়েছে পোর্থসকে, দ্যার্তেগা একাই ফিরছে রাজধানীতে। সে সেন্ট আলো দিয়ে ফিরল না, সন্দেহ হতে পারে লোকের। অন্য দরজা দিয়ে ঢুকে নোতরদামের কাছাকাছি আসতেই দেখল রাস্তার উপর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়িটা তার চেনা, গাড়ির মালিক কেচ অ্যাডজুটর গন্ডি, এই গন্ডি হলো নোতরদামের ভারপ্রাপ্ত মহাযাজক, আর্কবিশপের ভাইয়ের ছেলে, নিজে কার্ডিনাল পদবির প্রত্যাশী, রাজনীতির ক্ষেত্রে ম্যাজারিনের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।
যেহেতু সে ম্যাজারিনের প্রতিদ্বন্দ্বী সেই কারণেই জনতার একান্ত আপনজন আসলে প্যারিসের এই প্রজাবিদ্রোহের মূলে যাদের ইন্ধন আছে। তাদের মধ্যে প্রধান হলো গন্ডি।
রাস্তার মাঝখানে গন্ডির গাড়ি দেখে একটা বুদ্ধি এল দ্যার্তেগার মাথায়। একটু আগেও জানত না দ্যাগো কীভাবে বালক রাজা আর রানীকে প্যারিসের বাইরে নিয়ে যাবে এত বিদ্রোহীদের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। এখন সে খুশি হয়ে উঠল, উপায় একটা পেয়ে গেছে।
গাড়ির মাথায় কোচয়ান বসে বসে ঢুলছে, পিছন দিকে সহিসেরা নেই। হয়তো মালিকের অনুপস্থিতের সুযোগ নিয়ে কোনো হোটেলে খাবার খেতে গিয়েছে এই সুযোগে।
নিঃশব্দে গাড়ির ভেতর ঢুকল দ্যার্তেগা একটা দড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে কাঠের দেয়াল ফুটো করে। গাড়ি থেকে দড়ির একমাথা ঝুলছে। কোচয়ানের হাতের আঙুলে বাধা অন্য মাথা, এই দড়ি টান দিলেই ভেতর থেকে কোচয়ানের মনযোগ আকর্ষণ করা যাবে।
দড়ি টানল দ্যার্তেগা এবং হেঁকে বলল–‘প্যালেই রয়্যাল।
ধড়মড় করে উঠে বসল কোচয়ান দড়িবাধা আঙুল টান পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে তার কানে এল–‘প্যালেই রয়েল।’ হুকুম যে তার মনিবের মুখে থেকে আসেনি সেটা বেচারার মাথায় এক মুহূর্তের জন্যেও আসেনি, সদ্য ঘুম। ভেঙেছে তার। গলার আওয়াজের পার্থক্য তার বুঝার কথা নয়।
প্যালেই রয়্যাল অর্থাৎ রাজপ্রাসাদে যাবে তার মালিক–এটাই সম্ভব। তিনিই তো প্রজা বিদ্রোহের নেতা। কোচয়ান গাড়ি হাঁকিয়ে দিল।
প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে সে যখন সিঁড়ির নিচে থামল, তখনই লক্ষ্য করল গাড়ির পিছনে সহিসেরা নেই, তবে? তবে আর কি, মালিক তাদের কোনো কজে পাঠিয়ে দিয়ে থাকবেন। সুতরাং কোচওয়ান নিজেই লাফিয়ে নেমে এল গাড়ির দরজা খুলে দিতে।
আর দরজা খুলতেই গাড়ির ভেতর থেকে একটি লোক নেমে এসে দুই হাতে সজোরে গলা টিপে ধরল কোচওয়ানের। তারপর সে ডাকল দুইজন মস্কেটিয়ারকে, যারা তখন প্রাসাদে পাহারায় আছে।
তাদের হাতে কোচওয়ানকে ছেড়ে দিল দ্যার্তেগা–একে প্রাসাদের ভেতর কোনো নির্জন ঘরে নিয়ে আটকে রাখো। মুখ বেঁধে হাতে, পায়ে শিকল পরিয়ে, আর পোষাকটা খুলে আমাকে দাও। আমি যতক্ষণ একে ছেড়ে দিতে না বলছি, ছাড়বে না।
কোচওয়ানকে নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে চলেছেন মাস্কেটিয়াররা, দ্যাগো নিজে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে গেল প্রাসাদের পিছন দিকের দরজায়। এ দরজার চাবি সে ম্যাজারিনের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছিল, দরজা খুলে সে সোজা উঠে গেল রানীর মহলে। রাত তখন ঠিক এগারটা।
‘রানী তারই অপেক্ষায় আছেন।’
কোন বিদ্রোহী আটকাবে কো-অ্যাডজুন্ট গন্ডির গাড়ি? গাড়ি চালিয়ে প্যারিস থেকে নিরাপদে বেরিয়ে গেল একেবারে সেন্ট জার্মেইন, কোচওয়ানবেশে দ্যার্তেগা। সেখানে রাজার ছোট একটা বাড়ি আছে।