‘হায় ঈশ্বর এটা একটা প্রশ্ন হলো? যেতে হবে এখুনি।’
‘বেশ আমি এই মুহূর্তে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু আমরা যে যাচ্ছি এটা আপনি একবার মহারনীকে জানিয়ে এলে ভালো হয়।’
‘এসব সামান্য ব্যাপার মহারানীকে? সে কী? কেন?’
‘ব্যাপারটা মহারানীও সামান্য মনে করবেন, তার নিশ্চয়তা কী? আমাকে যদি যেতেই হয় মহারানীকে সেকথা আগে জানানো ছাড়া উপায় নেই, কার্ডিনাল।’
ম্যাজারিন ক্রুদ্ধ, বিরক্ত এবং ভীত হলেন, আড়ালে আড়ালে রানীর সঙ্গে একটা কিছু বন্দোবস্ত এদের হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই, কী সে বন্দোবস্ত? সেটা ম্যাজারিনের পক্ষে ক্ষতিকর নয়তো?
একবার মনে হয়েছিল, এরকম সাধারণ বিষয় নিয়ে রানীর কাছে যাওয়া তার পক্ষে মর্যাদা হানির ব্যাপার হবে, কিন্তু কৌতূহলের তাড়নায় তাকে যেতে হলো, রাণীর সঙ্গে এদের বোঝাপড়াটা কী রকম, একান্তভাবে জানা দরকার, সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন ম্যাজারিন, এসেই হেসে বললেন—’তুমি ঠিকই বলেছিলে লেফটেনান্ট, রানীকে না জানিয়ে যাওয়া তোমার উচিত হত না, তুমি একটা কাজের ভার পেয়েছ রানীর কাছ থেকে।’
‘যে কাজ আমি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না’ মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল দ্যার্তেগা।
মুহূর্তের জন্য লোকটার আত্ম অহংকার হতবাক করে দিল ম্যাজারিনকে, অনেক চেষ্টায় নিজেকে ঠিক করে বললেন—’রানী কি রাত এগারটায় বেরুচ্ছেন?’
‘আপনি রানীর মুখ থেকেই সে কথা শুনেছেন।’
‘তা শুনেছি, কিন্তু তুমি আমার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা করতে চাও, সে কথা শুনিনি। অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলা ম্যাজারিনের।
‘আপনার সম্পর্কে?’ আকাশ থেকে পড়ে দ্যার্তেগা।
‘বাঃ রানী চলে যাবেন, রাজা চলে যাবেন, আমি এখানে পড়ে থাকব কি বিদ্রোহীর হাতে চুচকাটা হওয়ার জন্য?’
‘কিন্তু যাবেন কি করে?’
‘রানীর গাড়িতে।’
‘অসম্ভব, জায়গা হবে না। বরং রানীকে পৌঁছে দিয়ে এসে তারপর আপনাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি।’
‘রানীকে পৌঁছে দিয়ে এসে, তারপর? বলি তারপর যদি তোমার প্যারিসে আসার আর প্রয়োজন না থাকে? অর্থাৎ তোমার ক্যাপটেন পদ এবং তোমার বন্ধুর উপাধি যদি রানী ওখান থেকেই দিয়ে দেন? তারপরও এই গরীব বিদেশীর কথা তোমাদের মনে থাকার এতখানি আশা করতে পারি না মঁসিয়ে দ্যার্তেগা।’
দ্যার্তেগা বেশ গম্ভীর ভাবে চিন্তা করছে কথাটা, তারপর বলল ‘আপনার ইচ্ছে কি?’
‘ইচ্ছে এই যে, রানীর সঙ্গে যদি যাওয়া না হয় আমার তা হলে রানীর আগেই আমি যাব, উনি যাবেন রাত এগারটায়। আমায় তুমি রাত দশটায় সেন্ট জার্মেইন শহরে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’
দ্যার্তেগা অতিকষ্টে হাসি থামায়। কী চালাক এই ইতালিয়ান যাজকটা!
‘সেটা অসম্ভব নাও হতে পারে, এখন তাহলে বলুন রাত দশটার সময় আপনাকে সেন্ট জার্মেইন নিয়ে যাওয়ার দরুণ আমাদের পাওনা কি হবে। বুঝতেই তো পারছেন অন্য লোকের পক্ষে যে কাজ অসম্ভব সেই কাজই যখন করতে হচ্ছে আমাকে, তখন মজুরিটাও লোভনীয় হওয়া দরকার।’
টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা করতে ম্যাজারিনের চিরদিনই অনীহা, তাই মহা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, কিন্তু রানীকে নিয়ে যাবার জন্য সেখানে টাকার কোনো কথা হয়নি বোধহয়।
আকাশ থেকে পড়ে দ্যার্তেগা রানী বা রাজা–এদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা, রাজার বা রানীর প্রজা বা সৈনিকদের জীবনের উপর দাবি রয়েছে একটা। ইচ্ছা করলেই তারা বলতে পারেন–তোমার জীবনটা আমাকে দিয়ে দাও, ওটা আমার দরকার হয়েছে, কিন্তু সে কথা অন্যদের ব্যাপারে খাটে না।
‘অন্যের বেলায় পারিশ্রমিকের দরকার হয়।’ বেশ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ম্যাজারিন। ম্যাজারিনের হাতে একটা হীরের আংটির দিকে বেশ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে দ্যার্তেগা। আংটি তার পরিচিত। বিশ বছর আগে এ আংটিটি তারই ছিল, তাকে ওটা রানী দিয়েছিলেন, তারপর ওটা দ্যাগো বেচে দিয়েছিল। রানীর প্রয়োজনে। টাকা দরকার হওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত কি জানি কেমন করে আংটিটি এই লোভী ম্যাজারিনের হাতে এসেছে।
তা যেভাবেই এসে থাকুক, দ্যার্তেগা ওই আংটি মজুরী হিসাবে না পেলে কিছুতেই শহরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে না ম্যাজারিনকে।
দ্যার্তেগার অর্থপূর্ণ চাহনির মানে বুঝতে না পারার মতো বোকা নন ম্যাজারিন।
এখন যেহেতু দর কষাকষির সময় নেই, সেটা বুঝেই ধীরে ধীরে, দ্যার্তেগার হাতে আংটিটি তুলে দিলেন এবং আংটি দেয়ার সাথে যেন আলোচনার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, এমনভাবে বললেন, আমি তাহলে রাত দশটার সময় তৈরি থাকব।
‘থাকবেন, আমি ঠিক সময়েই চলে আসব।’
‘কিন্তু গাড়ি? কোর গাড়িতে যাব আমি?’ জানতে চাইল ম্যাজারিন।
‘গাড়ি আমি নিয়ে আসব, আপনার মাথা ঘামাতে হবে না ও নিয়ে।’
.
পোর্থসের গাড়ি রাত ঠিক দশটার সময় প্রাসাদের পিছনে এসে দাঁড়াল, গাড়ির পিছনে পোর্থস।
মাস্কেটিয়ারের পোষাকেই একটা ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন ম্যাজারিন দরজার তলায় চাবি ঢোকাতে পারছেন না, হাত কাঁপছে উত্তেজনায়। চাবি চেয়ে নিলেন দ্যার্তেগা ম্যাজারিনের কাছ থেকে। চাবি নিয়ে তালা বন্ধ করল দ্যার্তেগা। কিন্তু চাবি ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের পকেটে রাখল। আর একবার আসতে হবে এই দরজা দিয়ে তাকে এক ঘণ্টা পরে।
গাড়িতে উঠে বসলেন ম্যাজারিন, পোর্থস আর দ্যার্তেগা দুপাশে, আগেই কোচম্যানকে বলে দেয়া ছিল, মাঝারি কদমে গাড়ি এগিয়ে চলল সেন্ট আনোর গেটের দিকে, তখন রাজপথে জনতায় পূর্ণ। একটু পরপরই চেঁচিয়ে উঠছে তারা ‘ম্যাজারিন নিপাত যাক।’ মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে মুখ বের করে দ্যার্তেগাও চিৎকার করছে, ‘নিপাত যাক ম্যাজারিন।’ ম্যাজারিন যতটা সম্ভব পিছনে সঙ্কুচিত হয়ে বসেছেন, এপাশে পোর্থস, ওদিকে দ্যার্তেগা মাঝখানে পুরোপুরি আড়ালে পড়ে গেছেন ম্যাজারিন, বিদ্রোহী জনতা মধ্যে মধ্যে উঁকি দিচ্ছে গাড়ির জানালা দিয়ে। দ্যার্তেগার ‘নিপাত যাক ম্যাজারিন’ চিৎকার শুনে খুশি হয়ে চলে যাচ্ছে।