প্যালেই রয়েলে বসে রাজমাতা অ্যান শুনলেন সব ঘটনা। তিনি কন্ডিকে ডেকে পরামর্শ করতে বসলেন কী ভাবে এই বিদ্রোহী প্রজাদের শায়েস্তা করা যায়। সব ঘটনা শুনলেন ম্যাজারিনও। তার গোপন স্বর্ণ ভাণ্ডার রাজপ্রসাদ থেকে সরিয়ে নিয়ে যে কোথায় লুকিয়ে ফেললেন, তা কেউ জানল না, কর্তির পরামর্শ অনুসারে চলাই স্থির করলেন অ্যানি, পালিয়ে যাবেন তিনি বালক রাজাকে নিয়ে। যাবেন সেইন্ট জামেইন শহরে। রাজার। একটা ক্ষুদ্ৰবাড়ি আছে সেখানে, সেটিই আপাতত রাজ প্রাসাদের কাজ করবে। রানী রীতিমতো উত্তেজিত। প্রজাদের জব্দ করার সুন্দর একটা মতলব এঁটেছে কন্ডি, প্যারিসের বিদ্রোহী ফ্রন্ডিরা মজা বুঝবে এবার। রাজা যদি না থাকেন, না থাকে ম্যাজারিও, শহরে তারা শৃঙ্খলা রক্ষা করবে কেমন করে? শহর অরাজক হয়ে যাবে যে!
তাই যাক, কৃতকর্মের ফল ভোগ করুক দুর্বিনীত প্যারিসবাসী। রানী যাবেন পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে। এমনভাবে শহর ত্যাগ করবেন, যাতে কেউ সন্দেহ না করতে পারে যে ওরা যাচ্ছে না সন্দেহ হলে আর যাওয়া হবে না, কারণ পথে পথে হাজার জনতা দিনরাত হল্লা করছে, তাদের ভেতর দিয়ে রাজা ও রাজা মাতার যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
অসম্ভব? নিশ্চয়ই তাই।
কিন্তু অসম্ভব সম্ভব করতে পারে, এমন লোক রানী দেখেছেন। সে, আজ বিশ বছর আগের কথা। প্যারিস থেকে লন্ডন পর্যন্ত রাজপথের দুই ধারে সৈন্যবাহিনী সাজিয়ে রেখেছিলেন। বিশাল সেই সৈন্য থেকে বের হয়ে যাওয়া যে কোনো যুগের যে কোনো বীরের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তবু সে অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো লোক পাওয়া গিয়েছেল তখন, এখন কি যাবে না? সেই দ্যার্তেগা তো রয়েছে। এই প্রাসাদের সীমানার মধ্যেই রয়েছে, আজ বিশ বছর ধরেই তো সে রানীকে পাহারা দিচ্ছে ও খানে বসে! আজ যদি তাকে ডাকা যায়–ডাকতেই হলো। ডাকলেন রানী, বিশ বছর পরে দ্বিতীয় বার ডেকে পাঠালেন দ্যাগোকে। দ্যার্তেগা প্রবেশ-করল দুরু দুরু বুকে, কিন্তু বাইরে থেকে দেখে কেউ তার অন্তরের চাঞ্চল্য অনুমান করতে পারবে না কখনও। অভিবাদন করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল রানীর আদেশের প্রতিক্ষায়।
অনেক ভণিতা করে তারপর রানী প্রকাশ করলেন তার বক্তব্য, একদিন তার মস্ত উপকার করেছিল দ্যার্তেগা। তার দরুণ যতখানি কৃতজ্ঞতা প্রত্যাশা করার অধিকার ছিল দ্যার্তেগার তা সে হয়তো পায়নি, কিন্তু সেই অভিযোগ অন্তরে পুষে রেখে আজ কি সে রানীর দ্বিতীয় অনুরোধ প্রত্যাখান করবে? যদি সত্যিই কোনো দ্বিতীয় অনুরোধ আজ আসে এই বিশ বছর পরে?
দ্যার্তেগা অবিচলিত স্বরে বলল–‘না কখনই প্রত্যাখান করব না। কৃতজ্ঞতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সৈনিকের তরবারি রাজা ও রাজমাতার যে কোনো প্রয়োজনে উন্মোচিত হওয়ার জন্যই তো রয়েছে। আদেশ করতে যেটুকু দেরি। উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা পালিত হবে।’
‘উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই?’ রানী অ্যান সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যদি কোনো অসম্ভব আদেশই করে বসি?’
‘অসম্ভব হলেও তা পালিত হবে। আর অসম্ভব যদি না হবে, তবে মহারানী দ্যার্তেগাকে কেন স্মরণ করবেন?’
রানী মনে মনে বলেন–লোকটার শক্তি আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে দম্ভও আছে প্রচুর।
কিন্তু মনের ভাবনা এখন মনেই থাকুক। বৃথা সময় নষ্ট করা চলে না বাজে কথা বলে। নিজের প্রয়োজনটা সংক্ষেপেই ব্যক্ত করলেন অ্যান ‘বিদ্রোহীদের ফাঁকি দিয়ে আমি যদি গোপনে রাজধানীর বাইরে যেতে চাই, সেটা কি সম্ভব?’
‘অবশ্যই সম্ভব।’
‘অবশ্য রাজাকে নিয়ে সেটা বুঝতে পারছ তো?’
‘রাজাকে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব।’
‘কী করে সম্ভব? রাজপথে গিজগিজ করছে বিদ্রোহীরা। পরীক্ষা না করে মাছিটাকেও তারা শহর থেকে বেরুতে দিচ্ছে না।’
‘তা না দিক, সেজন্য মহারানীর চিন্তা করতে হবে না, দুটি মাত্র শপথ করতে হবে রানীর, একটি হলো–এই পলায়নের কথা সবার কাছে গোপন রাখতে হবে। দুই এ ব্যাপারে সমস্ত ভার সম্পূর্ণভাবে আমার উপরে ছেড়ে দেবেন। একমাত্র তা হলেই আমি পারব একাজ সম্পূর্ণ করতে।’
রানী বললেন, ‘তাতে আমার আপত্তি নেই।’
‘রাত এারোটায় আমি মহারানীর সঙ্গে দেখা করব।’
রানীর রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই দ্যার্তেগার কোর্টের পিছনে টান পড়ল। ফিরে তাকাতেই দেখে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বেইন। বেইন প্রধানমন্ত্রী ম্যাজারিনের খাস চাকর।
‘মহামন্ত্রী ডেকেছেন আপনাকে’–বেইন জানাল।
‘জানতাম, ডাকতেই হবে।’
দ্যার্তেগা এসে সালাম জানাতেই ম্যাজারিন উচ্ছ্বসিত ভাবে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন–‘আরে এসো এসো। তোমাকেই আমার সবেচেয়ে বেশি দরকার। তোমাকে এবং তোমার সেই বন্ধু মঁসিয়ে ভ্যালোনকে তিনি এখনও ব্যারণ উপাধিটা পেতে চান তো?’
উত্তর দেয় দ্যার্তেগা—’চাইবেন না কেন? আপনি তা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
‘আর তুমি কি? তুমিও তো পেতে চাও ক্যাপটেন পদ?’
‘ক্যার্ডিনাল, উত্তর ওই একটাই।’
‘বেশ ও দুটো আনার জন্য তোমাদের দুজনকে একবার লন্ডন যেতে হবে।’ এমনভাবে ম্যাজারিন কথা বলছেন, যেন দুই বন্ধুকে তিনি খাবার ঘরটা একবার ঘুরে আসার জন্য অনুরোধ করছেন। দ্যার্তেগা মনে মনে যতই বিরক্ত হোক, মুখে বিন্দু মাত্র ভাব দেখাল না। শুধু বলল–আমরা প্রস্তুত কিন্তু যেতে হবে কখন?’