রানী বাসস্থানের গরীবি দশা দেখে ওরা দুজনই রেগে আগুন। ফরাসি সরকার এমনই নীচ যে মহান চতুর্থ হেনরীর কন্যাকে তারা উপযুক্ত আতিথেয়েতা দিতে নারাজ।
হেনরিয়েটার দুর্দশা দেখেই বিচলিত হয়েছে অ্যাথোস ও অ্যারামিস এখন হেনরিয়েটার মুখ থেকে কাতর আবেদন শুনেই দুজনে সমস্বরে প্রতিজ্ঞা করল যে ইংল্যান্ডে গিয়ে রাজা চার্লসের সেবায় তারা প্রাণ দেবে।
উইন্টার প্রশ্ন তুললেন দ্যার্তেগা আর পোর্থসের সম্পর্কে, তাদের কেন পাওয়া যাবে না?
অ্যাথোসই বুঝিয়ে দিল, ওরা ম্যাজারিনের পক্ষে এবং ম্যাজারিন ক্রমওয়েলের পক্ষে। কাজেই দ্যার্তেগা আর পোর্থসের সাহায্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
‘কী করে এটা সম্ভব হলো?’ জিজ্ঞাসা করেন উইন্টার। ওই নীচ ম্যাজারিনের আদেশ মানবে দ্যার্তেগা বা পোর্থসের মতো মহাপ্রাণ বীর প্ররুষ! এ যে কল্পনা করাও যায় না।
নিশ্বাস ফেলে অ্যাথোস বলল–‘ঘটনা চক্র ছাড়া আর কিছুই না, দ্যার্তেগা তো রাজকর্মচারী। যে যখন শাসনতন্ত্রের কাণ্ডারী, তারই আদেশ মানতে হবে সৈনিককে। আর পোর্থ? তার প্রয়োজন একটা উপাধি–ব্যারণ বা ডিউক। সে উপাধি ম্যাজারিন ছাড়া কেউ দিতে পারে না।’
রানী হেনরিয়েটা বিষণ্ণ ভাবে বললেন, ‘পারতাম আমি। একবার ইংল্যান্ডের প্রজা বিদ্রোহ দমন করে দিন আপনারা, সাহায্যকারী প্রত্যেককে আমি ডিউক উপাধি দেব, দেব ডিউকের মর্যাদা অনুযায়ী জমিদার। কিন্তু পোর্থস কথা দিয়েছে ম্যাজারিনের কথার খেলাপ করে না, এখন হেনরিয়টের প্রস্তাব নিয়ে পোর্থসের কাছে গেলে অপমানই করা হবে তার।’
ঠিক হলো দ্যার্তেগা আর পোর্থসের আশা ত্যাগ করে অ্যাথোস আর অ্যারামিস যাবেন উইন্টারের সঙ্গে, কোথায় তারা যাচ্ছেন, তা জানার দরকারও নেই বন্ধুদের বিদায় জানালেন, বন্ধুরা বিদেশে যাচ্ছে শুনে দ্যাগে তাদের পাঠিয়ে দিল সব পিস্তল, পোর্থসকে পাঠালে দুইশো লুই সমান ভাগ করে নেবে দুজনে।
দ্যার্তেগার কাছে আর একটি অনুরোধ ছিল অ্যাথোসের, রাওলের দেখাশুনা যেন করে সে, যখন সৈন্যবাহিনীতে সে ফিরে যাবে, তখন আর অভিভাবকত্বের প্রশ্ন উঠে না, যতক্ষণ রাজধানীর অশান্তির পরিবেশে সে থাকবে, ততক্ষণই তার অভিভাবকের প্রয়োজন, সে দায়িত্ব নেবার পক্ষে দ্যার্তেগার চেয়ে যোগ্যতর কে আছে? বীরত্বে, মর্যাদায়, দূরদর্শিতায়, দ্যার্তেগা অতুলনীয়। তার চেয়ে বড় কথা, সে রাওলকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে।
গেনম এর যুদ্ধে প্রিন্স কন্ডি জয় লাভ করেছেন, ফ্রান্সের গৌরব সূর্য আজ মধ্য আকাশে। শেষ হয়ে আসা রাজশক্তির মর্যাদা এতে অনেকখানি বেড়ে গেল। এই আনন্দের দিনে বড় একটা উৎসবের অনুষ্ঠান হলো সারাদেশে। রাজা ও রাজমাতা এলেন নোতরদাম গির্জায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেবার জন্য। জাঁকজমকের শেষ নেই, শহর ভেঙে পড়েছে নোতরদামের রাস্তায়।
প্রজারা এদিকে রাজার জয়ধ্বনি করে আকাশ ফাটিয়ে ফেলছে, রাজার পক্ষ থেকে রানী অ্যান ওদিকে একদল সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্রুসেলকে ধরে এসে ব্যাস্টিলে আটকে রাখার জন্য।
কে ব্রুসেল? জননায়ক। প্যারিসের জনগণের মুখপাত্র। কাজ শেষ হবে বলে আশা করলেও তা হলো না। জনগণ টের পেয়ে গেল, ব্রুসেলকে ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলছে রাজসৈন্যরা, কাতারে কাতারে মানুষ এসে পড়ল চারদিক থেকে। দাঙ্গা বেধে গেল। গাড়ি ঘিরে রেখেছে বিশজন সৈন্য। তাদের ঘিরে ধরেছে দুই হাজার দাঙ্গাবাজ।
অসম যুদ্ধে রাজসৈন্যরা কচুকাটা হয়ে যেতে বসেছে এমন সময়ে একটি তরুণ যোদ্ধা এসে সৈন্যদলের শক্তি বৃদ্ধি করল। বয়সে সে নবীন কিন্তু তরোয়াল চালাচ্ছে প্রবীণ সৈনিকের মতো। তার তরোয়ালের নাগালের ভেতরে যে আসছে, সে আর রক্ষা পাচ্ছে না।
এ হচ্ছে রাওল ব্রাগেলোন থেকে ফিরে এসে সবে প্যারিসে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। রাওলের তরোয়াল তাদের বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে পারল না। তাদের সম্মিলিত আক্রোশ এসে পড়ল রাওলের উপর। জীবন সংশয় হয়ে দাঁড়াল রাওলের।
হঠাৎ লম্বা তরোয়ালের আঘাতে ঘন জনতার ভেতর দিয়ে রাস্তা করে নিতে নিতে রাওলের কাছে এসে পড়ল দুজন সৈনিক। তারা দ্যার্তেগা আর পোর্থস।
দ্যার্তেগারা এসে পড়ায় শুধু রাওলের যে জীবন রক্ষা হলো তা নয়, ব্রুসলকেও ব্যাস্টিলে পাঠানো সম্ভব হলো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও দ্যার্তেগা বা পোর্থসের অস্ত্রের সামনে দাঁড়াবে জীবনের প্রতি এত বিতৃষ্ণা কারো নেই।
দ্যার্তেগা সেই দিনই রাওলকে সৈন্য শিবিরে পাঠিয়ে দিল, সেখানে সে, নিরাপদে থাকবে, প্যারিসে অনেক নাগরিক তাকে চিনে ফেলেছে, রাস্তায় বেরুনোই আর নিরাপদ নয় তার পক্ষে।
স্বয়ং অ্যাথোস দ্যার্তেগাকে অভিভাবক হিসেবে রেখে দিয়েছেন রাওলের। রাওল দ্যার্তেগার নির্দেশ অমান্য করতে পারল না।
রাওল প্যারিসে থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভালোই করল। আর একটা দিন দেরি হলে সে আর বেরুতে পারত না। কারণ এক রাতের মধ্যে রাজধানীতে বিরাট একটা পরিবর্তন এসে গেল। সকাল বেলায় লোকজন ঘরের বাইরে এসে দেখে রাস্তা আর রাস্তা নেই। ইট পাথর খুড়ে তুলে। কোথায় পুকুর তৈরি করা হয়েছে, কোথায় হয়তো পাহাড় বানিয়েছে। সৈন্যদের চলতে বাধা দেবার জন্য। শুধু কি ইট আর পাথর? উল্টানো গাড়ি, খালি পিপে, বিছানার খাট, বসার সোফা সব এনে এলোপাতাড়ি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে রাজপথে, অশ্বারোহী সৈন্যের এক পা চলার উপায় নেই।