- বইয়ের নামঃ টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার
- লেখকের নামঃ আলেকজান্ডার ডুমা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার
১. রাজধানীর সেন্ট আনোর রাজপথ
টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার
০১.
রাজধানীর সেন্ট আনোর রাজপথ ধরে বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া ছুটে চলেছে, দুই অশ্বারোহী, দুই বীরযোদ্ধা। তাদের নাম, দ্যার্তেগা এবং পোর্থস, ভিনসেন দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছে রাজবন্দি ডিউক অফ বোফর্ট। তাকে ধরে আনার জন্যই ছুটছে এই দুই বীরযোদ্ধা। অবশ্য এদের পিছনে বড়সড় একদল অশ্বারোহী সৈন্য আছে, কিন্তু অনেক পিছিয়ে পড়েছে তারা। তাতেই বোঝা যায় সৈন্যদের উপর এরা মোটেই নির্ভরশীল নয়।
রাজপথের শেষ মাথায় পৌঁছাতেই সামনে এক গ্রাম। তার শেষ প্রান্তে এক বড় বনের শেষ প্রান্তে ছোট এক পাহাড়। সেই পাহাড়ের চূড়ো থেকে দেখা যায় একটা পানিশূন্য লেকের ওপারে ভিনসেন দুর্গের মাথা আকাশ ছুঁয়েছে। লেকের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে ঘোড়া, পাশেই সেন্টমোর গ্রাম। ডিউক অফ বোফর্ট ঐ দুর্গের একটি মাথা থেকে দড়ি ঝুলিয়ে সেন্ট মোরের অন্য প্রান্তে নেমে পালিয়ে গেছেন। সেখানটায় এখনও জটলা করছে দুর্গের পাহারাদাররা। জটলার কাছে পৌঁছে প্রশ্ন করল দ্যার্তেগা ‘ডিউকের কোনো সাহায্যকারী ছিল?’
উত্তর দিল সৈন্যরা চারজন ছিল, আমরা দুর্গের দেয়ালের উপর দেখেছি তাদের। কিন্তু গুলি ছুঁড়েও কিছু করতে পারিনি বন্দুকের নাগালের বাইরে থাকায়। মাত্র চারজন। পোর্থাসের উদ্দেশ্যে বলল দ্যার্তেগা, ভাবখানা-চারজন কোনো ব্যাপার হল? অন্তত যোদ্ধা হলে না হয় দ্যার্তেগা আর পোর্থসের মতো দুই যোদ্ধাকে বাধা দিতে সক্ষম হত।
দ্যার্তেগা আবার জিজ্ঞাসা করল–‘কতক্ষণ আগে পালিয়েছে ওরা।‘
‘সোয়া দুই ঘণ্টা হবে।’ জবাব দিল পাহারারত সৈন্যরা।
‘মাত্র!’ পোর্থসের দিকে ফিরল দ্যার্তেগা। বোফর্ট কোথায় পাবে এত তেজি ঘোড়া আমাদের মতো। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে ওদের ঠিকই ধরে ফেলব আমরা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পোর্থস। বেয়ার্ড আর ভলকান নামের এই দুই ঘোড়ার মালিক সে। সবে ঝড়ের বেগে দুই ঘণ্টা ছুটে এসেছে। আবারও যদি পাঁচ ছয় ঘণ্টা এই বেগে ছুটতে হয় তাহলে ও দুটোর শেষ পরিণতি কী হবে ভেবে শঙ্কা জাগছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তা নিয়ে চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। শুরু যখন হয়েছে কাজটা শেষ করতে হবে। পলাতকদের ধরতেই হবে, তবেই মিলবে দ্যার্তেগার জন্য ক্যাপ্টেন এবং নিজের জন্য ব্যারন পদবী। এই আশ্বাস এসেছে ফ্রান্সের মহামন্ত্রী স্বয়ং ম্যাজারিনের কাছ থেকে।
বিশ বছর, হ্যাঁ সুদীর্ঘ বিশ বছর ধরে দ্যতেঁগা মাস্কেটিয়ার বাহিনীর লেফটেন্যান্ট, কিন্তু ক্যাপ্টেনের পদে উন্নতির কোনো আশা নেই, কারণ ট্রিভাইন এখন জীবিত। কাজেই তিনি মারা না গেলে ক্যাপ্টেনের পদ খালি হবে না, আর দ্যার্তেগার তার মৃত্যু কামনাও করতে পারে না, তিনি দ্যার্তেগা বিশেষ উপকারী। রানী অ্যান এর জন্য অনেক কিছুই করেছে দ্যার্তেগা তাকে চরম অবমাননার হাত থেকে রক্ষা করেছে একদিন। এজন্যই রানীর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সমস্ত জীবন। ফরাসি দেশের পরিচালিকা এখন সেই রানী। রাজা চতুর্দশ লুই নাবালক তাও অভিভাবক হিসেবে রানী অ্যান দেশ শাসন করছেন। তিনি ইচ্ছে করলে দ্যার্তেগাকে মার্শাল পদে বসাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। না করার কারণ তিনি নিজের ইচ্ছায় কোনো কিছুই করেন না। মহামন্ত্রী কার্ডিনা ম্যাজিরিনের হাতের পুতুল রানী, বাজারে জনশ্রুতি আছে বিধবা হওয়ার পর অ্যান এই ইতালীয় ভাগ্যান্বেষীকে গোপনে বিবাহ করেছেন।
ম্যাজারিন নিজেও চরম লোভী ও স্বার্থপর। যেখানে নিজের কোনো লাভ নেই, এমন কোনো কাজ সে নিজেও করবে না। রানীকেও করতে দেবে না।
সুতরাং রানী দ্যার্তেগার জন্য কিছুই করতে পারেনি এবং যেখানে উপকারীর উপকার করার সম্ভাবনা নেই, সেখানে উপকারীর কথা মনে রাখলেই শুধু বেদনা থাকে বলেই রানী ইচ্ছে করেই ভুলেছেন দ্যার্তেগাকে। যদিও দুজনই একই প্রাসাদে থাকেন, রানী ভেতরে, দ্যার্তেগা প্রাসাদের পাহারায়।
হ্যাঁ বিশ বছর দ্যার্তেগা প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে কিন্তু রানী তাকে মনে রাখেননি। অবশেষে একদিন ম্যাজারিনই বাধ্য হলেন দ্যার্তেগাকে খুঁজে বের করতে। গরিব প্রজাদের উপর নতুন কর বসিয়েছেন ম্যাজারিন অথচ যে বিশাল পরিমাণ অর্থ এই সব কর থেকে আসে তা রাজকোষে জমা হয় না, হয় ম্যাজারিনের নিজের তহবিলে। সিন্দুক ভরা হীরে, মুক্তো ম্যাজারিনের অথচ রাজা চতুর্দশ লুইকে থাকতে হয় রীবি হালে।
স্বভাবতই প্রজারা এতে অসন্তুষ্ট যে কোনো অভিজাত, প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রজাদের পক্ষে কথা বলেছেন তক্ষুণি তাকে আটকে বন্দি করেছেন ব্যাস্তিল কারাগারে। ম্যাজারিনের নির্দেশে রানী অ্যান ব্যামাসপিয়ার ব্যাস্তিল কারাগারেই মারা গিয়েছেন, বোফর্ট ভিনসেন থেকে পালিয়েছেন পাঁচ বছর কারাবাসের পর। বোফর্টকে মুক্ত করার জন্য তার আত্মীয় বন্ধু জমিদারেরা গোপনে চেষ্টা করছেন, একথা গুপ্তচরেরা আগেই জানিয়েছেন ম্যাজারিনকে, এদিকে রাজধানী প্যারির জনগণ যে এসব নিয়ে প্রায় বিদ্রোহের পর্যায়ে। পৌঁছেছেন সেকথাও। ম্যাজারিন যেদিকে তাকান, সেখানেই শুধু শত্রু আর শত্রু। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ কেউ গোপনে। চিন্তিত হয়ে মহামন্ত্রী ভাবতে লাগলেন কমপক্ষে দুই চারজন ঘনিষ্ট বন্ধুও যদি তার থাকত।