সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দেখি দরদর করে ঘামছি আমরা। সেলেস্তে সবসময় যেখানে বসে সেই সেখানে ঢোকার দরজার সামনে বসে আছে। স্থূলকায়। পেটের ওপর তার শাদা অ্যাপ্রন আর শাদা গোঁফজোড়া পাকানো। আমাকে দেখে সহানুভূতি জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার খুব খারাপ লাগছে কি না। বললাম, ‘না’। কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছিল আমার। গোগ্রাসে খাওয়ার পর কফি দিয়ে শেষ করলাম খাবার-পর্ব। তারপর ঘরে ফিরে খানিকটা ঘুমালাম, কারণ বেশ মদ গিলেছিলাম। ঘুম থেকে জেগে, বিছানা ছেড়ে উঠবার আগে সিগ্রেট খেলাম একটা। খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই ট্রাম ধরার জন্যে দৌড়াতে হল। পুরোদমে চলছিল অফিস আর সারাটা বিকেল কেটে গেল তার সঙ্গে তাল রাখতে রাখতে। অফিস-ছুটিটা তাই এল স্বস্তি হয়ে এবং ঠাণ্ডায় জেটির ধারে পায়চারি করছিলাম আস্তে আস্তে। আকাশটা সবুজ এবং এই নিরেট অফিসের পর বাইরে বেরনোটা ভীষণ আরামপ্রদ। যাক, সোজা ফিরলাম বাসায়, কারণ কিছু আলু সেদ্ধ করার দরকার ছিল।
হলঘরটা আঁধার, তাই যখন সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম তখন বুড়ো সালামানোর সঙ্গে প্রায় ধাক্কা খেলাম। সে আমার সঙ্গে একই তলায় থাকে। সবসময়ের মতো তার কুকুরটাও আছে তার সঙ্গে। আট বছর ধরে এ-দুজন অবিচ্ছিন্ন। সালামানোর স্প্যানিয়েলটা কুৎসিত এক জন্তু। সারা শরীরে চর্মরোগ; আমার মনে হয় খোসপাঁচড়া। কুকুরটার গায়ে এখন পশম নেই বিন্দুমাত্র, বদলে আছে বাদামি বাদামি চাকতি। মনে হয় কুকুরটার সঙ্গে ছোট ঘরটাতে একসঙ্গে থাকার দরুন সালামানোর আকৃতিও হয়ে গেছে অনেকটা এর মতো। তার চুল ভীষণ পাতলা আর গালে লালচে দাগ। আর কুকুরটাও মনে হয় মনিবের মতো বিশ্রী কুঁজোভঙ্গিতে হাঁটাটা আয়ত্ত করেছে। কারণ, সবসময় সে মাথাটা যতদূর সম্ভব সামনে বাড়িয়ে নাকটা মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে হাঁটে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তারা পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করে।
দিনে দুবার, এগারোটা আর ছ’টার সময়, বুড়োটা তার কুকুরকে নিয়ে বেড়াতে বের হয় আর আট বছর ধরে এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। রু দ্য লিয়তে আপনি তাদের দেখতে পাবেন, কুকুরটা যত জোরে পারে তাকে টেনে নিয়ে। চলছে, যতক্ষণ-না বুড়ো মনিবটি পা হড়কে পড়ো-পড়ো হচ্ছে। তখন সে তাকে পেটায়, গাল দেয়। কুকুরটা দুটো পা পিছনে দিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। এবার তার প্রভুর পালা তাকে টেনে নেয়ার। খানিক পর কুকুরটা আবার সবকিছু ভুলে গিয়ে ফের জোরে জোরে শেকল টানতে থাকে। ফলে, আরও কিছু প্রহার, গালিগালাজ। তারপর তারা দাঁড়ায় ফুটপাতে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে, কুকুরটার দৃষ্টিতে ভয় এবং মানুষটির দৃষ্টিতে ঘৃণা। যখনই তারা বের হয় তখনই এটা ঘটে। কুকুরটা যখন আবার কোনো ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়াতে চায় তখন তার মনিব তাকে দাঁড়াতে না দিয়ে টেনে নিতে থাকে। আর। হতভাগ্য স্প্যানিয়েলটা রাস্তায় ফোঁটা ফোঁটা জলের দাগ রেখে যায়। কিন্তু ব্যাপারটি যদি ঘরে ঘটে, তার অর্থ আরেকচোট প্রহার।
আট বছর ধরে হয়ে আসছে এরকম। সেলেস্তে তো এটাকে বিষম লজ্জার কথা বলে উল্লেখ করে। বলে, এ-ব্যাপারে কিছু করা উচিত। কিন্তু কোন ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। যখন হলের ভেতর সালামানোর সঙ্গে আমার দেখা হল। তখন সে কুকুরটার ওপর হম্বিতম্বি করছিল। কুকুরটা ঘেউঘেউ করছিল আর সে। জারজ ‘নোংরা খচ্চর ইত্যাদি বলে গাল দিচ্ছিল। “শুভ সন্ধ্যা’ বললাম আমি, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে সে কুকুরটাকে গাল দিয়ে যেতে লাগল। সুতরাং ভাবলাম, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি কুকুরটা কী করেছে। কিন্তু এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে সে চিৎকার করতে লাগল, ব্যাটা খেকি কুত্তা…’ ইত্যাদি। আমি স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু মনে হল, কুকুরটার গলায় সে কিছু লাগাবার চেষ্টা করছে। গলাটা খানিকটা উঁচুতে তুললাম। পিছন না-ফিরেই সালামানো চাপা রাগে স্বগতোক্তি করতে লাগল, ব্যাটা সবসময় এরকম করে। শিক্ষা দেয়া উচিত ব্যাটাকে। তারপর সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল, কিন্তু কুকুরটি চেষ্টা করল প্রতিরোধ করার, শুয়ে পড়ল সে মেঝেতে, ফলে তাকে শেকল ধরে ধাপে-ধাপে টেনে নিতে হল।
আমার সঙ্গে একই তলায় যে-লোক থাকে সে ঠিক এ-সময় নিচে থেকে উপরে উঠে এল। বেশির ভাগ লোকের মতে, সে একজন বেশ্যার দালাল। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, সে কী করে, তখন সে উত্তরে বলে, মালগুদামের দারোয়ান। তবে এটা ঠিক, পাড়ায় সে লোকপ্রিয় নয়। কিন্তু প্রায়ই আমার সঙ্গে তার কিছু-না-কিছু কথা থাকে এবং মাঝে মাঝে ঘরে এসে অল্পস্বল্প কিছু বলে সে চলে যায়, কারণ আমি তার কথা শুনি। আসল ব্যাপার, তার কথা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে। সুতরাং তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। নাম তার সেনতেস; রেমন্ড সেনতেস। বেঁটে পুষ্ট গড়ন। নাক তার মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো এবং পোশাকআশাকে সে ফুলবাবুটি। সেও আমাকে একবার সালামানোর কথা বলেছিল। সালামানো তার কুকুরের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করে তা খুবই লজ্জার বিষয় এবং তার এরকম ব্যবহারে আমি বিরক্ত হই কি না। উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘না’।