চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমি তামাকঅলার মতো বসলাম। এভাবে বসা আরামদায়ক। বসে বসে কয়েকটা সিগারেট শেষ করার পর ঘরে গেলাম। সেখান থেকে একটুকরো চকোলেট নিয়ে এসে বসলাম জানালার কাছে। খাবার জন্যে। একটু পরেই আকাশটা ঢেকে গেল মেঘে। ভাবলাম, বুঝি কালবৈশাখি এল। যাক, কিছুক্ষণ পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল, পরিষ্কার হল বটে কিন্তু মনে হতে লাগল যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এবং এ-ভাবটা চারদিকে বেশ অন্ধকার করে তুলল। বেশ কিছুক্ষণ আমি আকাশ দেখলাম।
পাঁচটার সময় ট্রামের বিকট আওয়াজ শোনা গেল। শহরতলির স্টেডিয়াম থেকে তা আসছে যেখানে একটা ফুটবল ম্যাচ ছিল। পুরো ট্রামভরতি লোক, এমনকি পাদানিতে পা রেখেও লোক ঝুলছিল। তারপর আরেকটা ট্রামে এল খেলোয়াড়রা। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল একটা করে ছোট সুটকেস যা দেখে বুঝলাম এরা খেলোয়াড়। দলের গান গাইছিল তারা ‘কিপ দা বল রোলিং বয়েজ’। তাদের একজন আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, তাদের একচোট নিয়েছি। আমি হাত নাড়লাম। বললাম, ‘চমৎকার!’ তারপর প্রাইভেট গাড়ির স্রোত বইতে লাগল রাস্তায়।
আকাশটা গেল আবার বদলে; বাড়িগুলির চুড়োর পিছনদিকটায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল একটা লালচে আভা। সঁঝ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাগুলি আবার ভরে উঠতে লাগল। লোকজন তাদের বৈকালিক ভ্রমণশেষে ফিরছিল এবং এসব ফিরতি লোকদের মধ্যে আমি সেই ছোটখাটো ভদ্রলোক ও তার স্থূলাঙ্গী স্ত্রীকে দেখতে পেলাম। ছেলে মেয়ে দুজন মা-বাবার পিছে পিছে ক্লান্তস্বরে প্যানপ্যান করতে করতে আসছিল। কিছুক্ষণ পর, কাছেপিঠের সিনেমাহলগুলি তাদের দর্শকদের উগরে দিল। লক্ষ করলাম, ছেলে-ছোকরারা লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে এবং অন্যান্য সময় থেকে জোরেশোরে হাত নাড়ছে। তারা যে মার্কামারা একটি পশ্চিমা বুনো’ ছবি দেখে এসেছে সে-সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। শহরের মাঝখানের সিনেমাহলগুলির দর্শকরা ফিরল কিছুক্ষণ পর। তাদের বেশির ভাগেরই মুখ গোমড়া, যদিও কয়েকজন। তখনও হাসছিল। যাহোক, মোটকথা, তাদের পরিশ্রান্ত লাগছিল। কয়েকজন আমার জানালার নিচে ঘোরাফেরা করতে লাগল। একদল মেয়ে এল হাতে হাত রেখে। আমার জানালার নিচের ছোকরারা তাদের পাশ ঘেঁষে যাবার জন্যে তাদের দিকে মুখ করে হাঁটতে লাগল এবং চেঁচিয়ে মজার মন্তব্য করল যা শুনে মেয়েরা পিছন ফিরল, হাসল। মেয়েগুলিকে চিনলাম। পাড়ারই মেয়ে, তাদের দুএকজনের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, দেখে হাত নাড়ল।
ঠিক সে-সময় একসঙ্গে রাস্তার বাতিগুলি জ্বলে উঠল। রাতের আকাশে যে তারাগুলি মাত্র জ্বলে উঠেছিল সেগুলি আরও নিষ্প্রভ হয়ে গেল। বাতি এবং একটানা রাস্তার এত খুঁটিনাটি দেখার জন্যে চোখটা টনটন করছিল। বাতিগুলির নিচে খানিকটা জায়গা উজ্জ্বল। কোনো ট্রাম যখনই সে-জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল তখনই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল কোনো মেয়ের চুল, বা হাসি বা রুপোর চুড়ি।
তার পরই কমে গেল ট্রামের আনাগোনা। বাতি আর গাছের ওপর আকাশকে দেখাচ্ছিল কালো ভেলভেটের মতো। রাস্তা খালি হতে লাগল। এবং এমন এক সময় এল যখন রাস্তায় কাউকে দেখা গেল না এবং বিকেলের দেখা প্রথম বেড়ালটা ধীরস্থিরভাবে নির্জন রাস্তাটা পার হল।
আমার মনে হল, এখন রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করা উচিত। চেয়ারে ঝুঁকে নিচে এতক্ষণ দেখছিলাম যে দাঁড়াতেই ঘাড়টা ব্যথা করে উঠল। নিচে নেমে খানিকটা রুটি আর স্নগেটি কিনলাম, তারপর রান্নাঘরে দাঁড়িয়েই খাওয়াটা সারলাম। ভাবছিলাম, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আরেকটা সিগারেট খাব, কিন্তু হিমেল হয়ে আসছিল রাতটা। তাই ইচ্ছেটা দমন করলাম। জানালা বন্ধ করে যখন ফিরছিলাম তখন তাকালাম আয়নার দিকে, দেখলাম আয়নায় আমার টেবিলের এক কোনা, তার ওপর স্পিরিটল্যাম্প ও পাশে ছড়ানো কয়েক টুকরো রুটি ফুটে উঠেছে। হঠাৎ মনে হল, আরেকটা রোববার কোনোরকমে কাটিয়ে দিলাম। মাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে এবং কাল থেকে আমি আবার আগের মতো অফিস যেতে শুরু করব। সত্যি, আমার জীবনের কিছুই বদলায়নি।
.
৩.
সকালটা খুব ব্যস্ত ছিলাম অফিসে। আমার কর্তাও ছিলেন বেশ খোশমেজাজে। এমনকি তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ক্লান্ত কি না এবং তার পিঠেপিঠেই প্রশ্ন, মার বয়স ছিল কত। খানিক ভেবে বললাম, ষাটের কাছাকাছি। কারণ, আমি আরেকবার ভুল করতে চাচ্ছিলাম না। এটা শুনে তিনি কেমন যেন নিশ্চিন্ত হলেন। কেন, আমি জানি না–ভাবলাম, যাক ইতি হল বিষয়টার।
টেবিলে আমার বিল অফ লেডিঙের পাহাড় আর এসবগুলি দেখতে হবে আমাকে। দুপুরে খেতে যাবার আগে হাত ধুলাম। প্রতিদিন দুপুরে হাত ধুতে আমার বেশ ভালো লাগে। বিকেলে ব্যাপারটা কিন্তু বিরক্তিকর। কারণ, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত লোকজনের ব্যবহারের ফলে তোয়ালেটা ভিজে জবজব করে। ব্যাপারটা একবার কর্তার নজরে এনেছিলাম। এটা যে নিতান্ত বাজে সে বিষয়ে তিনি একমত হয়েছিলেন আমার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর কাছে এটা সামান্য ব্যাপার। অন্যদিনের চেয়ে আর-একটু দেরি করে অফিস ছাড়লাম। সাড়ে বারোটায় ফরোয়ার্ডিং ডিপার্টমেন্টের ইমানুয়েলের সঙ্গে বেরোলাম। অফিস থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বন্দরের জাহাজের মালপত্রের ওঠানামা দেখলাম। সূর্য হয়ে উঠছিল উত্তপ্ত। ঠিক সে-সময় ইঞ্জিন ও শেকলের শব্দ করতে করতে একটা ট্রাক এল। ইমানুয়েল বলল ট্রাকটাতে লাফিয়ে উঠতে। দৌড়োতে শুরু করলাম আমি। ট্রাকটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। আমাদের তাই বেশকিছুটা পথ ধাওয়া করতে হল পিছু-পিছু। ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দের জন্যে সবকিছু খানিকটা গুলিয়ে ফেলছিলাম। সচেতন ছিলাম, শুধু একপাশে জাহাজগুলির গাঢ় রঙের নোঙর ও অদূরে দোলায়মান মাস্তুল এবং ক্রেন ও যন্ত্রপাতির ভিড়ের মাঝ দিয়ে জলের ধার-বরাবর পাগলের মতো দৌড় সম্পর্কে। আমিই প্রথম ধরলাম ট্রাকটাকে, তারপর লাফ দিয়ে ওপরে উঠে টেনে-হেঁচড়ে তুললাম ইমানুয়েলকে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছিলাম আমরা। তা ছাড়া এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলার ফলে ঝাঁকুনি অবস্থা আরও সঙ্গিন করে তুলল। ইমানুয়েল ঢোক গিলে কানে-কানে বলল, শেষ পর্যন্ত উঠলাম তা হলে।