অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আরও দুএকটা ঘটনা আমার মনে আছে। সেই বৃদ্ধটির কথা ধরা যাক যখন তিনি শেষবারের মতো গ্রামের ঠিক বাইরে আমাদের ধরে ফেলেছিলেন। অত্যধিক পরিশ্রম বা দুঃখ বা হয়তো দুটোর জন্যেই চোখ তার ভরে গিয়েছিল জলে। কিন্তু মুখের বলিরেখার জন্যে চোখের পানি গাল বেয়ে নামতে পারছিল না–বরঞ্চ তার জরাজীর্ণ মুখের চারদিকে পড়ছিল ছড়িয়ে এবং প্রাচীন জীর্ণ মুখে সৃষ্টি করেছিল এক চকচকে ভাবের।
মনে পড়ছে আরও–গির্জের চেহারা, রাস্তার গ্রামবাসী, কবরের ওপর লাল জেরানিয়াম; পিরেজের অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কাপড়ের পুতুলের মতো কুঁকড়ে মুকড়ে গিয়েছিলেন তিনি, মা’র কফিনের ওপর ঝরে-পড়া লাল মাটি যার সঙ্গে মিশে আছে শাদা শেকড়ের টুকরো; তারপর আরও লোক, গলার স্বর, কাফের বাইরে বাসের জন্য অপেক্ষা, ইঞ্জিনের গুঞ্জন, এবং যখন প্রথম আমরা ঢুকলাম আলজিয়ার্সের ঝলমলে রাস্তায় তখন মনে আনন্দের অল্প শিহরন এবং তারপর সোজা বিছানায় গিয়ে একটানা বারো ঘণ্টা ঘুম।
.
২.
ঘুম থেকে উঠেই বুঝলাম, দুদিন ছুটি নিতে চাওয়ায় কেন আমার ওপরঅলা মুখভার করেছিলেন। আজ শনিবার। শনিবার যে আজ হবে একথা আগে আমার মনে হয়নি। মনে হল তখন, যখন বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ওপরঅলা বুঝেছিলেন, একাধারে চারদিন আমি ছুটি পাচ্ছি, এবং এটা তাকে খুশি করবে এমন আশা করা যায় না। তবু বলব, দোষটা আমার নয়। মাকে গতকাল কবর না দিয়ে যদি আজ দেওয়া হত তা হলেও আমি শনিবার আর রোববার–এ-দুদিন ছুটি পেতাম। কিন্তু যাহোক, আমি আমার ওপরঅলার দিকটাও বুঝতে পেরেছিলাম। ঘুম থেকে ওঠাটা ছিল কষ্টকর, কারণ গতকালের অভিজ্ঞতা সত্যিই আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। দাড়ি কামাতে কামাতে ভাবছিলাম, কীভাবে দিনটা কাটানো যেতে পারে। ভাবলাম, বাইরে গিয়ে খানিকক্ষণ সাঁতার কাটলে বোধহয় ভালো লাগবে। সুতরাং পোতাশ্রয়ে যাবার ট্রাম ধরলাম।
আগের মতোই আছে সবকিছু। সুইমিং পুলে ছেলে-ছোকরার ভিড়, আর ঐ ভিড়ে ছিল আমার অফিসের এককালীন টাইপিস্ট মারি কারদোনাও। ঐ সময় আমি তার প্রতি বেশ উৎসুক ছিলাম এবং মনে হয় সেও আমায় পছন্দ করত। কিন্তু আমাদের অফিসে ছিল সে মাত্র কয়েকদিন, তাই কিছুই আর দানা বাঁধেনি।
ভেলায় তাকে ওঠাবার সময় হাত দিয়ে তার বুক ছুঁয়ে দিলাম। তারপর সে। নৌকায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল আর আমি দাঁড় বাইতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর, পাশ ফিরে সে তাকাল আমার দিকে। চুলগুলি লুটোপুটি খাচ্ছিল তার চোখের ওপর এবং হাসছিল সে। দাঁড় রেখে দিয়ে এসে বসলাম তার পাশে। বাতাস বেশ আরামদায়ক-উষ্ণ। তামাশার ছলে আমার মাথা রাখলাম তার কোলে। সে কিছু বলল না দেখে আমিও আর মাথা সরালাম না। পুরো আকাশ আমার চোখে। নীল আর সোনালি। মাথার নিচে মারির পেটের ধীর ওঠানামা অনুভব করছিলাম। আধঘণ্টারও বেশি, আধো-ঘুমে, আধো-জাগরণে শুয়ে ছিলাম আমরা। তারপর রোদ আরও প্রখর হলে মারি ঝাঁপ দিল পানিতে। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। সাঁতরিয়ে। আমি তাকে ধরে ফেললাম এবং হাত দিয়ে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে দুজনে। পাশাপাশি সাঁতরাতে লাগলাম। সে তখনও হাসছিল।
সুইমিং পুলের কিনারে দাঁড়িয়ে যখন আমরা নিজেদের শুকোচ্ছিলাম তখন মারি বলল, ‘দ্যাখো, আমি তোমার চেয়েও বাদামি।‘ তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিকেলে সে আমার সঙ্গে সিনেমায় যাবে কি না। আবার হাসল সে। বলল, ‘হ্যাঁ’, যদি আমি তাকে ঐ হাসির বইটা দেখাতে নিয়ে যাই যাতে ফারনান্দল অভিনয় করছে এবং যার কথা এখন সবাই আলোচনা করছে।
কাপড় পরা যখন আমরা শেষ করলাম তখন সে আমার কালো টাই দেখে জিজ্ঞেস করল, আমি কারও জন্যে শোক পালন করছি কি না। জানালাম তাকে যে আমার মা মারা গেছেন। কখন?’ জিজ্ঞেস করল সে। গতকাল’, বললাম আমি। কিছু সে বলল বটে কিন্তু মনে হল খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে সে। আমি তাকে প্রায় বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে দোষটা আমার নয়। কিন্তু ঠিক সে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ, একথাটা আগেও একবার ওপরঅলাকে বলেছিলাম, এবং বুঝেছিলাম কথাটা শুনতে বোকার মতো। বোকামি হোক বা না-হোক, এরকম একটা ঘটনা ঘটলে সবাই নিজেকে খানিকটা দোষী মনে না করে পারে না।
যাহোক, বিকেলের দিকে মারি সব ভুলে গেল। মাঝে মাঝে ছবিটাতে কিছু হাসির খোরাক ছিল, কিন্তু পুরোটা যাচ্ছেতাই। সিনেমাহলে, সে তার পা দিয়ে আমার পা টা চেপে ধরছিল এবং আমি তার বুকে হাত বুলোচ্ছিলাম। ছবিশেষে তাকে চুমো খেলাম খানিকটা আনাড়ির মতো। তারপর সে আমার সঙ্গে ফিরে এল ঘরে।
ঘুম থেকে জেগে দেখি, মারি চলে গেছে। সে বলেছিল, সকালে উঠে প্রথমেই তার খালা খোঁজ করবে। মনে পড়ল, আজ রোববার; বিরক্ত লাগল। রোববারের। জন্যে আমি কখনও হা-পিত্যেশ করি না। মাথা ফেরালাম এবং অলসভাবে মারির ছেড়ে-যাওয়া বালিশের গন্ধ নিলাম। বালিশে সমুদ্রের জলের গন্ধ। ঘুমোলাম দশটা পর্যন্ত; তারপর দুপুর পর্যন্ত শুয়ে-শুয়ে সিগারেট টানলাম। ঠিক করলাম, প্রতিদিনের মতো সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় আজ আর খাব না। কারণ, সেখানে গেলেই তারা আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলবে এবং কেউ জেরা করুক তা আমার অপছন্দ। সুতরাং কড়াইয়ে কয়েকটা ডিম ভেজে খেয়ে নিলাম। রুটি ছাড়াই খেলাম ডিমগুলি। কারণ ঘরে রুটি ছিল না আর নিচে গিয়ে তা তামাকঅলার দোকানের পাশের ছোট রেস্তোরাঁ সে পিয়েরো-র বেয়ারা খালি রেস্তোরাঁর ধুলো ঝাড়ছে। রোববারের একটি আদর্শ বিকেল।