শববহনকারীদের একজন জায়গা ঠিক করে দিল আমাদের। শববহনকারীযানের আগে আগে পুরোহিত, দুপাশে কালো-পোশাক-পরা চারজন, তারপর আমি আর ওয়ার্ডেন এবং সবশেষে নার্স আর বুড়ো পিরেজ।
আকাশটা ভেসে যাচ্ছিল আলোর বন্যায়। বাতাসও উঠছিল তেতে। গরম বাতাসের হল্কা অনুভব করছিলাম পিঠে। আর আমার কালো স্যুট অবস্থা আরও শোচনীয় করে তুলেছিল। বুঝতে পারছিলাম না কেন এতক্ষণ সঙ্কারের জন্যে আমরা অপেক্ষা করলাম। টুপিটা পরেছিলেন বুড়ো পিরেজ, এখন আবার তা খুলে ফেললেন। একটু সরে আমি তাঁকে দেখছিলাম আর ওয়ার্ডেন আমাকে তার সম্পর্কে আরও কিছু বলছিলেন। মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, প্রায়ই নমিত বিকেলে আমার মা আর বৃদ্ধ পিরেজ একসঙ্গে দীর্ঘপথ হাঁটতেন। মাঝে মাঝে গ্রাম পর্যন্ত যেতেন হেঁটে। অবশ্য সঙ্গে থাকত একজন নার্স।
গ্রামের দিকে তাকালাম। সাইপ্রেসের সারি যেন পাহাড় আর তারপর দিগন্তে গিয়ে ঠেকেছে। উষ্ণ লাল মাটি মিশে গেছে সবুজের সঙ্গে। এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দুএকটা নিঃসঙ্গ বাড়ি। মা’র অনুভূতিটা অনুভব করতে পারছিলাম। এদিকের বিকেলটা নিশ্চয় বোধহয় শোকের মতো। এখন সকালের প্রখর তাপে সবকিছু ঝলসাচ্ছে, তাই নিসর্গকে মনে হচ্ছে খানিকটা অমানুষিক, নিষ্ঠুর।
অবশেষে, আমরা একটা বাঁক পেরুলাম। আর তখনই লক্ষ করলাম, পিরেজ একটু খোঁড়াচ্ছেন। গাড়িটার গতি যতই বাড়ছিল বৃদ্ধ ততই তাল হারিয়ে ফেলছিলেন। আরেকজনও পিছিয়ে পড়ে আমার গতিতে চলে এলেন। সূর্যের খুব দ্রুত উপরে উঠে যাওয়া দেখে আশ্চর্য হলাম। বাতাসে পোকামাকড়ের শব্দ। ঘাসের তেতে ওঠার সরসর আওয়াজ। মুখ বেয়ে ঘাম ঝরছিল। যেহেতু সঙ্গে আমার কোনো টুপি ছিল না, তাই রুমাল দিয়ে বাতাস খাবার চেষ্টা করছিলাম।
সেই পিছিয়ে-পড়া ভদ্রলোক কী যেন বললেন আমাকে। ঠিক ধরতে পারলাম। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাত দিয়ে ধরে-থাকা রুমাল দিয়ে মাথা মুছলেন। ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন টুপিটা। জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমাকে কী বলছিলেন। উপরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন :
আজকের রোদটা খুব কড়া, তাই না?
‘হ্যাঁ’, বললাম আমি।
কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলেন, যাকে কবর দেয়া হচ্ছে তিনি আপনার মা?
‘হ্যাঁ’, আবার বললাম আমি।
‘তাঁর বয়স হয়েছিল কত?’
‘এই আর-কি…’ আসলে আমি ঠিক জানতাম না মা’র বয়স কত ছিল।
তারপর চুপ করে রইলেন তিনি। পিছন ফিরে দেখলাম, প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছেন পিরেজ। একহাতে রাখা টুপিটা দোলাচ্ছেন, গতির সঙ্গে তাল রাখার জন্যে। আমি ওয়ার্ডেনের দিকেও একবার তাকালাম। তিনি সতর্কভাবে মাপা পা ফেলে হাঁটছিলেন। কপালে তাঁর ঘামের ফোঁটা, কিন্তু তা মুছবার কোনো চেষ্টাই তিনি করছিলেন না।
মনে হল আমাদের মিছিলটা যেন একটু দ্রুত তালে এগুচ্ছে। যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম, সেদিকেই দেখছিলাম আলোর বন্যায় ভেসে-যাওয়া গ্রামের নিসর্গ। আকাশটা এত ঝকঝকে যে উপরের দিকে চোখ ভোলার সাহস পাচ্ছিলাম না। শেষে, আমরা আলকাতরা-দেয়া এক নতুন রাস্তায় এসে উঠলাম। গরমে গলে যাচ্ছে আলকাতরা। আর যিনিই আলকাতরায় পা রাখছেন তারই পায়ের ছাপ পড়ছে সেখানে। উজ্জ্বল কালো ছাপ। গাড়োয়ানের আঁকালো কালো টুপিটাকে শবযানের মাথায় ঐ চটচটে বস্তুর স্তূপের মতো লাগছে। এটা সবাইকে এনে দিচ্ছে এক স্বপ্নিল ভাব। নীল-শাদা তাপের তরঙ্গ উপরে, আর চারদিকে এই কালো : শবযানের চকচকে কালো, লোকদের পোশাকের ম্লান কালো আর রাস্তায় পায়ের ছাপের রুপোলি কালো। এ ছাড়া আছে গন্ধ। গরম চামড়া এবং শবযানের ঘোড়ার মলের গন্ধ, আর ধূপের ধোয়ার সরু রেখা। এগুলো এবং গতরাতে না ঘুমানোর দরুন আমার চোখ আর ভাবনাগুলি যাচ্ছিল জড়িয়ে।
আমি আবার পিছন ফিরে তাকালাম। পিরেজকে যেন মনে হচ্ছিল বহুদূরে, চোখ-ঝলসানো রোদে প্রায় অস্পষ্ট। তারপর তিনি মিলিয়ে গেছেন একেবারে। এটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম আমি। ভাবলাম, বুঝি পথ ছেড়ে তিনি ক্ষেতে নেমেছেন। সামনে নজর পড়ল রাস্তার একটি বাক। স্বাভাবিকভাবে পিরেজ, এ- অঞ্চল যার ভালোভাবে চেনা, আমাদের ধরার জন্যে শর্টকাট ধরছিলেন। বাঁক ঘোরার মুখে ধরে ফেললেন তিনি আমাদের, কিন্তু তারপর আবার পড়লেন পিছিয়ে। আরেকটা শর্টকাট মেরে আবার তিনি আমাদের ধরে ফেললেন। পরবর্তী আধঘণ্টা কয়েকবার এরকম হল। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই তার গতিবিধির ওপর আমার নজর রাখার আগ্রহটা কমে গেল। কপালের দুপাশের রগদুটো দপদপ করছিল। আমি আর চলতে পারছিলাম না বললেই হয়।
তারপর সবকিছু হঠাৎ করে হয়ে গেল। আর এত নিখুঁত এবং স্বাভাবিকভাবেই যে তার তেমন কোনো বিবরণ আমার মনে নেই। তবে মনে আছে, আমরা যখন গ্রামটা ছাড়িয়ে এসেছি তখন নার্স আমায় যেন কী বলেছিল। গলার স্বর তার আমাকে অবাক করেছিল, কারণ মুখের সঙ্গে স্বরের কোনো মিল নেই। স্বরটা একটু কাঁপা-কাঁপা। সে যা বলেছিল তা হল, কেউ যদি খুব আস্তে হাঁটে তবে তার সর্দিগর্মি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার যদি কেউ খুব তাড়াতাড়ি হাঁটে তবে ঘেমে যায় এবং পরে গির্জের ঠাণ্ডা বাতাস তার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তার যুক্তিটা বুঝলাম। অর্থাৎ যে-কোনোভাবে সর্দিগর্মি হতে পারে।