বেশ ক্লান্ত লাগছিল। দারোয়ান আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলে নিজেকে খানিকটা পরিপাটি করে নিয়েছিলাম। আমাকে সে আরও খানিকটা দুধ-মেশানো কফি দিল যা আমাকে তুলেছিল চাঙা করে। বাইরে যখন বেরোলাম, সূর্য তখন বেশ উপরে উঠে গেছে। মারেনজো আর সমুদ্রের মাঝে পাহাড়চুড়োয় আকাশ হয়ে উঠেছে রক্তিম। ভোরের বাতাস বইছিল, যাতে ছিল স্নিগ্ধ লোনা স্পর্শ। মনে হচ্ছিল, দিনটা খুব ভালো যাবে। অনেকদিন গ্রামে আসিনি আমি। এবং দেখলাম ভাবছি, মা’র এই ব্যাপারটা না থাকলে কী চমৎকারভাবেই-না খানিকটা হেঁটে বেড়াতে পারতাম।
উঠোনের এক প্লেনগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভিজে মাটির গন্ধ নিলাম আর তারপর দেখলাম, আমার আর ঘুম পাচ্ছে না। অফিসের সহকর্মীদের কথা চিন্তা করলাম এরপর। ঠিক এ-সময় ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার জন্যে তারা তৈরি হচ্ছে। এ-সময়টা ছিল আমার জন্যে সবচেয়ে বিশ্রী সময়। দশ মিনিট কি আরও কিছুক্ষণ আমি এসব ভাবলাম। তারপর ঘরের ভেতর বেজে-ওঠা ঘণ্টার শব্দ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করল। জানলার বাইরে থেকে দেখছিলাম কারা যেন ভেতরে চলাফেরা করছে। ফের সব শান্ত হয়ে গেল। সূর্য উঠে গেল আরেকটু ওপরে, পা তেতে ওঠা শুরু করেছে। উঠোন পার হয়ে দারোয়ান কাছে এসে জানাল ওয়ার্ডেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। গেলাম তার অফিসে। কিছু কাগজপত্র দিলেন তিনি সই করার জন্যে। পিন-স্ট্রাইপ পাতলুন পরনে তাঁর, সবকিছু কালো। ফোনের রিসিভারটা তুলে তাকালেন তিনি আমার দিকে : শববহনকারী লোকেরা এসেছে কিছুক্ষণ আগে। তারা এখনই কফিনের ভ্রু আটকাবে। আমি কি তাদের খানিকটা অপেক্ষা করতে বলব যাতে তোমার মাকে শেষবারের মতো দেখতে পাও?
‘না’, বললাম আমি।
গলা নামিয়ে কী যেন বললেন তিনি টেলিফোনে। ‘ঠিক আছে ফিজেক, লোকজনদের সেখানে যেতে বলো।’
তারপর তিনি জানালেন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তিনিও যাবেন। ধন্যবান জানালাম তাঁকে। খাটো পা-দুটি মেলে দিয়ে, ডেস্কের পেছনে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন তিনি। বললেন, নার্স ছাড়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমি এবং তিনিই একমাত্র শোককারী। কারণ আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী আশ্রমের কেউ শবানুগমন করতে পারবে না। তবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগের রাত্রিতে মৃতদেহের পাশে বসে তারা রাত জাগতে পারে।
‘এটা তাদের জন্যেই’, ব্যাখ্যা করলেন তিনি, যাতে তারা কাতর না হয়ে পড়ে। কিন্তু আজ আমি তোমার মা’র পুরনো এক বন্ধুকে শবানুগমনের বিশেষ অনুমতি দিয়েছি। থমাস পিরেজ তার নাম’, হাসলেন ওয়ার্ডেন, ‘গল্পটা বেশ করুণ বটে। সে আর তোমার মা অভিন্ন হয়ে উঠেছিল। আশ্রমের অন্য বৃদ্ধরা ঠাট্টা করে বলত যে, পিরেজ একজন ফিয়াসে পেয়েছে। তোমরা বিয়ে করেছ কবে? জিজ্ঞেস করত তারা। হেসে উড়িয়ে দিত সে প্রসঙ্গটি। অনেকটা তামাশার মতো হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটি। সুতরাং বুঝতেই পারছ, তোমার মা’র মৃত্যুতে সে কতটা আঘাত পেয়েছে। ভেবে দেখলাম, শবানুগমনের অনুমতি না দিলে খারাপ দেখাবে। তবে আমাদের ডাক্তারের পরামর্শে তাকে রাত জাগতে দিইনি।‘
তারপর আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। খানিক পর ওয়ার্ডেন চেয়ার ছেড়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন।
বললেন : ‘আরে ঐ তো মারেনগোর পাদরি চলে এসেছেন! অবশ্য সময়ের খানিকটা আগেই এসেছেন।‘ তিনি আমায় জানালেন, হেঁটে গির্জেয় পৌঁছতে লাগবে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। কারণ, গির্জেটা গ্রামের একেবারে ভেতরে। তারপর নিচে নেমে এলাম আমরা।
সাময়িক শবাগারের দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাদরি। সঙ্গে তাঁর দুজন অধস্তন কর্মচারী। তাদের একজনের হাতে রুপোর ধূপধার। পাদরি তার উপর ঝুঁকে ধূপাধারের রুপোর শিকলটা ঠিক করছিলেন যেটার সঙ্গে তা লটকে ছিল। আমাদের দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, আমাকে ‘পুত্র’ বলে সম্বোধন করে কিছু কথা বললেন। তারপর আমাদের নিয়ে ঢুকলেন ভেতরে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, চারজন লোক কালো পোশাক পরে কফিনের পিছে দাঁড়িয়ে আর কফিনের ঢাকনাটা আটকানো স্কু দিয়ে। ঠিক সে-সময় ওয়ার্ডেন বললেন, শবাধার নেওয়ার গাড়ি এসেছে। পাদরি শুরু করলেন তার প্রার্থনা। তারপর সবাই যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল। সেই চারজন একটুকরো কালো কাপড় নিয়ে এগিয়ে গেল কফিনের দিকে আর আমি, পাদরি এবং অন্যান্যরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজার পাশে। আগে কখনও আমি দেখিনি তাকে। ‘ইনি মঁসিয়ে মারসো’, ওয়ার্ডেন বললেন। মহিলাটিকে। আমি তার নামটা ঠিক ধরতে পারলাম না, কিন্তু মনে হল তিনি বোধহয় এ-আশ্রমের নার্স। তার সঙ্গে যখন পরিচয় করিয়ে দেয়া হল তখন মাথা নিচু করে তিনি আমায় অভিবাদন জানালেন। তাঁর দীর্ঘ কৃশমুখে বিন্দুমাত্র হাসির রেশ ছিল না। আমরা সব দাঁড়ালাম দরজার একপাশে; কফিন বের করা হলে পর পিছুপিছু গিয়ে দাঁড়ালাম দরজার কাছে। সেখানে শবাধার নেয়ার জন্যে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। গাড়িটা আয়তাকার, মসৃণ এবং কালো রঙের। গাড়িটা আমাকে মনে করিয়ে দিল অফিসের কলমদানির কথা।
গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল ছোটখাটো এক মানুষ। পরনে সুন্দর অথচ অদ্ভুত পোশাক। বুঝলাম, তার কাজ হল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দেখাশোনা করা। অনেকটা অনুষ্ঠানের কোনো কর্তাব্যক্তির মতো। তার পাশে লাজুক এবং অপ্রতিভভাবে দাঁড়িয়েছিলেন মা’র বিশেষ বন্ধু থমাস পিরেজ। মাথায় তার নরম একটা ফেল্ট হ্যাট। চুড়োটা যার পুডিঙের মতো উঁচু আর ধারটা বেশ বড় কফিনটা দরজার কাছে আসতেই তিনি মাথা থেকে টুপি নামিয়ে নিলেন। পরনে তার কালো একটা টাই যা তাঁর উঁচু ডবল শাদা কলারের তুলনায় খুব ছোট। ব্রণময় গোল নাকের নিচে তার ঠোঁটদুটি কাঁপছিল। কিন্তু যা আমার দুষ্টি আকর্ষণ করল, তা হল তাঁর কান, দোদুল্যমান রক্তিম কান যা মোমের মতো হালকাভাবে তার গালের দুপাশে ঝুলে রয়েছে। আর কানের চারপাশে সিল্কের মতো শাদা পশম।