‘না, না, বাবা’, বললেন তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে, ‘আমি তোমার দিকে, যদিও তুমি তা বুঝছ না–কারণ হৃদয় তোমার কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও আমি তোমার জন্যে প্রার্থনা করব।’
তারপর কী হল বুঝতে পারলাম না। ভিতরে ভিতরে বোধহয় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল, তাই চিৎকার করে কথা বলতে লাগলাম। তাঁকে অপমান করতে শুরু করলাম; বললাম, তার ঐ বাজে প্রার্থনা আমার জন্যে না-করলেও চলবে, একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার চাইতে যন্ত্রণা ভালো। তাঁর ক্যাসোকের গলাটা ধরে একধরনের ক্রোধ এবং আনন্দের সঙ্গে যা মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিল তা-ই বলতে লাগলাম। দেখুন-না, তিনি কী নিশ্চিত। অথচ তার একটি ধারণার দামও কোনো রমণীর একটি চুলের থেকে বেশি নয়। চিরদিন যেভাবে জীবনযাপন। করেছেন তা মৃতের মতো এবং তিনি যে বেঁচে আছেন সে-সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত না। মনে হতে পারে আমার অঞ্জলি শূন্য। কিন্তু আসলে নিজের ওপর আমার বিশ্বাস আছে, সবকিছু সম্পর্কে ধারণা আছে, তার থেকেও নিশ্চিত আমি বর্তমান জীবন এবং এগিয়ে-আসা মৃত্যু সম্পর্কে। আমি ঠিক বলেছিলাম, এখন ঠিক বলছি এবং সবসময় ঠিক বলে এসেছি। আমি একভাবে জীবনযাপন করে এসেছি, ইচ্ছে করলে অন্যভাবে জীবনযাপন করতে পারতাম। আমি ঐভাবে এ-কাজ। করেছিলাম, অন্যভাবে করিনি, আমি এমন করিনি বরং অমন করেছি। আর তার মানে কী? সবসময় আমি এই সময়ের জন্যে অপেক্ষা করে আছি, আগামীকাল বা অন্য কোনোদিনের ঐ সকালের জন্যে, যা আমার যৌক্তিকতা প্রমাণ করবে। কিছুরই, কোনোকিছুরই, তেমন গুরুত্ব নেই, এবং আমি ভালো করে জানি, কেন। তিনি নিজেও তা ভালো জানেন। আমার ভবিষ্যতের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিগন্ত থেকে, অবিরতভাবে একধরনের মৃদু হাওয়া বয়ে আসছে আমার দিকে, সমস্ত জীবন ধরে, অনাগত দিন থেকে। এবং আসার পথে সে-হাওয়া আমার ভিতরের সমস্ত ধ্যানধারণা সমান করে দিয়েছে যা এতদিন ধরে মানুষরা আমার ভিতরে গড়ে তুলতে চেয়েছে, এমনকি সে-সময়ও যখন আমি একই ধরনের অবাস্তব। জীবনযাপন করে আসছিলাম। অন্য কারও মৃত্যু, বা কোনো মায়ের ভালোবাসা বা তার ঈশ্বর আমার কাছে এদের মূল্য কী? বা একজন যেভাবে জীবনযাপন। করতে চায়, একজন যেভাবে ভাগ্য বেছে নিতে চায়, সেই একই ভাগ্য আবার ‘বেছে’ নিতে বাধ্য হয় শুধু আমাকে নয়, আরও হাজার লক্ষ সুবিধাভোগী মানুষকে, যারা তাঁর মতো, আমাকে নিজের ভাই বলে সম্বোধন করেছে। অবশ্যই-অবশ্যই তাকে তা দেখতে হবে? প্রতিটি মানুষ যারা বেঁচে আছে তারা সবাই সুবিধাভোগী, শুধুমাত্র একটি মানবশ্রেণী আছে, সুবিধাভোগী শ্ৰেণী। একদিন তাদের সবাইকে একইভাবে মরতে হবে, অন্যান্যদের মতো তখন তার পালাও আসবে। তা ছাড়া খুনের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর কাউকে যদি মরতে হয় মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় না-কাঁদার জন্যে, তাতেও-বা কী আসে যায়? কারণ। অন্তিমে তো দুটোর পরিণতি একই। সালামানোর স্ত্রী এবং সালামানোর কুকুর সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। সেই রোবট-মহিলাও অপরাধী’, যেমন অপরাধী প্যারিসের সেই মেয়েটি যে ম্যাসনকে বিয়ে করেছে; বা মারি, যে চেয়েছিল আমি তাকে বিয়ে করি। কী লাভ হত যদি সেলেস্তে থেকে রেমন্ড আমার আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হত, যার যোগ্য সে? কী আসে যায় যদি এ-মুহূর্তে মারি তার নতুন বয়ফ্রেন্ডকে চুমো খেতে থাকে? এমন একজন হতভাগ্য হিসেবে কি তিনি বুঝতে পারছেন না আমার ভবিষ্যৎ থেকে যে ঝড়ো হাওয়া বয়ে আসছে তার মানে আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি?…
আমি এত জোরে চিৎকার করছিলাম যে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, আর ঠিক তখনই ওয়ার্ডাররা ছুটে এসে আমার মুঠো থেকে পাদরিকে মুক্ত করার চেষ্টা করল। একজন এমন ভঙ্গি করল যেন আমাকে মারবে। পাদরি তাদের শান্ত করে একমুহূর্তের জন্যে চুপচাপ আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম, তার চোখে পানি টলটল করছে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি সেল ত্যাগ করলেন।
তিনি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু এ-উত্তেজনা আমায় ক্লান্ত করে তুলেছিল, তাই বিছানায় ঢলে পড়লাম। বোধহয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, কারণ জেগে দেখি তারারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে গ্রামের কোলাহল মৃদুভাবে শোনা যাচ্ছিল, আর মাটি ও লবণের গন্ধমাখা ঠাণ্ডা রাত্রির বাতাস আমার গালে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল। ঘুমেলো গ্রীষ্মরাত্রির চমৎকার শান্তি আমাকে স্রোতের মতো আলোড়িত করে তুলল। এবং ঠিক ভোর হবার আগে কানে। ভেসে এল একটি স্টিমারের বাঁশির শব্দ। মানুষ-মানুষীরা এমন এক পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করছে যার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে আমার কাছে চিরদিনের জন্যে। এতদিনের মধ্যে এই প্রথমবার আবছাভাবে মায়ের কথা মনে পড়ল। এবং মনে। হল এখন বুঝলাম, কেন জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি একজন ‘ফিয়াঁসে’ বেছে। নিয়েছিলেন, কেন আবার নতুন করে সব শুরু করতে চেয়েছিলেন। সেই আশ্রমেও যেখানে জীবনের শিখা প্রায় নিবুনিবু, সেখানেও সন্ধ্যা নামত বিষণ্ণ সান্ত্বনার মতো। মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে মা’র নিশ্চয় মনে হয়েছিল মুক্তির তীরে কারও পৌঁছে যাওয়ার মতো, যে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে প্রস্তুত। পৃথিবীর কারও কারও কোনো অধিকার নেই তার জন্যে অশ্রুবিসর্জনের। আমার নিজেকেও নতুন করে জীবন শুরু করার জন্যে তৈরি মনে হল। যেন এই বিশাল ক্রোধ আমাকে। পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে, আশা শূন্য করে দিয়েছে, এবং তারাভরা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে, এই প্রথম, প্রথমবারের মতো প্রকৃতির প্রসন্ন নির্লিপ্ততার কাছে মন। খুলে দিলাম। অমন অনুভব বস্তুতপক্ষে ভ্রাতৃসম, যে-অনুভূতি আমাকে সচেতন করেছে যে আমি সুখী এবং সুখী ছিলাম। সকল সিদ্ধি অর্জনের জন্যে, একটু কম নিঃসঙ্গতাবোধের জন্যে আমার কেবল আশা আছে যেদিন আমার শিরচ্ছেদ করা হবে সেদিন যেন দর্শকের এক বিশাল ভিড় থাকে, আর তারা যেন কুৎসিত চিৎকারে আমাকে বরণ করতে থাকে।