সরসর এক আওয়াজে ঘুম ভাঙল। চোখ বন্ধ করার পর মনে হয়েছিল ঘরের বাতিগুলি যেন আরও জোরালো হয়ে জ্বলছে। কোথাও কোনো ছায়ার চিহ্নমাত্র নেই। এবং প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি বাঁক বা কোণের বহিঃরেখা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। মা’র বন্ধু, বৃদ্ধরা সব ঘরে ঢুকছিলেন। গুনলাম, মোট দশজন। প্রায় শব্দহীনভাবে সন্ধ্যা ছটায় যেন তারা ভেসে এলেন। চেয়ারে যখন তারা বসলেন তখন বিন্দুমাত্র শব্দ হল না। আমার জীবনে এত পরিষ্কারভাবে আমি আর কাউকে দেখিনি; তাঁদের কাপড়চোপড় বা চেহারার কোনো ডিটেল আমার নজর এড়াল না। কিন্তু, তবুও তাঁদের কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না, এবং বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে তারা সত্যিই বিদ্যমান।
প্রায় প্রতিটি মহিলার পরনে অ্যাপ্রন। কোমরে শক্ত করে বাঁধা ছিল অ্যাপ্রনের দড়ি। এতে তাঁদের পেটগুলোকে বেশ বড় লাগছিল। বৃদ্ধাদের এতবড় পেট আগে আমার নজরে পড়েনি। তবে অধিকাংশ বৃদ্ধই বেতের মতো শুকনো, এবং সবার হাতে লাঠি। তাদের যে-জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছিল তা হল, তাদের মুখের দিকে তাকালে চোখ নজরে পড়ছিল না। চোখগুলিকে দেখা যাচ্ছিল বলিরেখার জালে আটকে-থাকা ঘোলাটে আলোর মতো।
চেয়ারে বসে তারা তাকালেন আমার দিকে। দাঁতহীন মাড়ি দিয়ে ঠোঁট চুষতে চুষতে অস্বস্তির সাথে মাথা নাড়লেন তাঁরা। আমি বুঝতে পারছিলাম না, তারা কি আমায় শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, না কিছু বলতে চাইছেন, না এটা বয়সের দোষ। ভাবতে চাইলাম, তারা বোধহয় তাদের মতো করে আমায় শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া ছিল অদ্ভুত। দারোয়ানকে ঘিরে-থাকা ঐ বৃদ্ধের দল নিষ্কম্প চোখে আমাকে দেখছে আর মাথা নাড়ছে। মুহূর্তের জন্যে মনে হল, তারা আমার বিচার করতে বসেছেন।
মিনিট কয়েক পর একজন মহিলা কাঁদতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় সারিতে বসেছিলেন তিনি। তাঁর সামনে একজন মহিলা থাকায় তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে মাঝে মাঝে থেমে তিনি ঢোক গিলছিলেন। মনে হচ্ছিল, তার এ- কান্না বোধহয় আর কখনও থামবে না। অন্যেরা এর প্রতি তেমন নজর দিচ্ছিল না। নিথর হয়ে বসেছিল তারা চেয়ারে, তাকাচ্ছিল কখনও কফিনের দিকে, কখনও-বা নিজেদের লাঠির দিকে অথবা অন্য কোনো জিনিসের দিকে। আর যেটার দিকেই তাকাচ্ছিল সেটা থেকে আর চোখ ফেরাচ্ছিল না। মহিলাটি কাঁদছিলেন তখনও। তাকে আমি চিনিনে কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছিল তার কান্না থামানো উচিত। কিন্তু কিছু করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। খানিক পর, সেই দারোয়ানটি মাথা নুইয়ে ফিসফিস করে তাকে যেন কী বলল। তিনিও মাথা নেড়ে অস্পষ্টভাবে কিছু বললেন যা আমি বুঝতে পারলাম না। তিনি ঠিক আগের মতোই ফোঁপাতে লাগলেন।
দারোয়ান উঠে দাঁড়াল। চেয়ার নিয়ে এসে বসল আমার পাশে। প্রথমে সে রইল চুপ করে, তারপর আমার দিকে না-তাকিয়ে বলতে লাগল:
‘আপনার মা’র খুব ভক্ত ছিলেন এই মহিলা। তাঁর মতে, এ-পৃথিবীতে আপনার মা-ই ছিলেন তাঁর একমাত্র বন্ধু। কিন্তু এখন তিনি একেবারে একেলা।’
কিছুই বলার ছিল না আমার। নিস্তব্ধতা বিরাজ করল কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে মহিলার ফোঁপানি ও ঢোক গেলাও কমে এল। এবং একসময় থেমে গেল ফোপানিও। নাক ঝেড়ে বসে রইলেন তিনি চুপচাপ।
আমার ঝিমুনি কেটে গিয়েছিল, ক্লান্ত লাগছিল খুব আর পা-টাও কামড়াচ্ছিল। ভীষণভাবে। এখন বুঝলাম, এই লোকদের নিস্তব্ধতা চেপে বসেছে আমার স্নায়ুর ওপর। খালি অদ্ভুত ধরনের একটা শব্দ হচ্ছিল, বেশ থেমে থেমে এবং প্রথমে তা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যাক, কিছুক্ষণ মনোযোগ দেয়ার পর বুঝলাম এ কিসের শব্দ।
বুড়ো লোকগুলি গালের ভেতরটা চুষছিলেন জিভ দিয়ে, তাই শব্দ হচ্ছিল অমন যা আমার কাছে হয়ে উঠেছিল রহস্যময়। নিজেদের চিন্তায় তারা এত মগ্ন ছিলেন যে, তারা কী করছেন তা তারা নিজেরাও খেয়াল করছিলেন না। আমার মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে, তাদের মাঝে রাখা মৃতদেহটাকে বুঝি তাঁরা আমল। দিচ্ছেন না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ধারণাটা ছিল ভুল।
দারোয়ান সবাইকে কফি দিলে আমরা তা পান করলাম। তারপর আমার আর তেমন কিছু মনে নেই; কোনোরকমে কেটে গেল রাতটা। একটা জিনিস শুধু মনে আছে। একসময় হঠাৎ আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম বুড়োরা সব ঘুমুচ্ছেন। জেগে রয়েছেন শুধু একজন। দুহাতে লাঠিটা চেপে ধরে তার ওপর থুতনি রেখে। কঠোরভাবে তাকিয়ে ছিলেন তিনি আমার দিকে যেন অপেক্ষা করছিলেন আমার ঘুম ভাঙার। তারপর আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর কিন্তু আবার ঘুম ভেঙে গেল কারণ পায়ে ঝিঁঝি ধরেছিল।
ভোরের ম্লান আলো দেখা গেল স্কাইলাইট দিয়ে। কয়েক মিনিট পর জেগে উঠলেন একজন, তারপর শুরু করলেন কাশতে। বড় একটা নকশা-করা রুমালে মুখ রেখে কাশছিলেন তিনি। কাশির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল বুঝি তিনি বমি করার চেষ্টা করছেন। একে একে জেগে গেল সবাই তারপর। দারোয়ান বলল, যাবার সময় হয়েছে এখন।’ শুনে তারা সবাই উঠে দাঁড়ালেন। রাতে ভালো ঘুম না-হওয়ার ফলে মুখ তাদের হয়ে গেছে লম্বাটে আর পাঁশুটে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যাবার আগে সবাই তাঁরা করমর্দন করলেন আমার সঙ্গে, যেন একরাতে আমরা কত অন্তরঙ্গ হয়ে গেছি যদিও সারারাত আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।