এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তাকালেন সোজাসুজি আমার চোখের দিকে। এটা যে একধরনের চালাকি তা আমি জানি। মাঝে মাঝে আনন্দ পাবার জন্যে ইমানুয়েল এবং সেলেস্তের ওপর এ-ধরনের চালাকি করতাম এবং দশবারের মধ্যে ন’বারই তারা অস্বস্তিকরভাবে চোখ সরিয়ে নিত। দেখলাম পাদরিমশায় এই খেলায় দড়, কারণ তার চোখের পাতা একবারও কাঁপল না। এবং যখন তিনি কথা বললেন তখনও দেখি তার গলার স্বর শান্ত : ‘তোমার কি কোনো আশা নেই? তুমি কি মনে করো যখন তুমি মৃত্যুবরণ করো তখন তুমি ঠিকঠিকই মৃত্যুবরণ করো এবং আর কিছুই থাকে না?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।‘
চোখ নামিয়ে তিনি আবার বসে পড়লেন। বললেন, আমার জন্যে সত্যিই তিনি দুঃখিত। আমি যে-ধরনের চিন্তা করছি সে-ধরনের চিন্তা মানুষের জীবন অসুখী করে তুলতে বাধ্য।
পাদরি আমায় বিরক্ত করে তুলেছিলেন। আর আমি ঠিক সেই স্কাইলাইটের নিচে বসে দেয়ালে কাঁধ রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম। যদিও তিনি কী বলছিলেন তাতে কান দিচ্ছিলাম না, তবুও মনে হল তিনি আবার আমায় প্রশ্ন করছেন। তারপর তার গলার স্বর আরও জরুরি, তপ্ত হয়ে উঠল, বুঝলাম তিনি। সত্যিই দুঃখবোধ করছেন। তখন আমি তার দিকে আরও মনোযোগ দিলাম।
তিনি বললেন, তিনি নিশ্চিত যে, আমার আপিল সফল হবে। কিন্তু আমার ওপর অপরাধের বোঝা চেপে আছে যা থেকে অবশ্যই আমাকে মুক্তি পেতে হবে। তাঁর মতে মানুষের বিচার মূল্যহীন; শুধু ঈশ্বরের বিচারে যায় আসে। বললাম, পূর্বোক্তটি আমায় অভিযুক্ত করেছে। হ্যাঁ, একমত হলেন তিনি, কিন্তু তা আমাকে আমার পাপ থেকে মুক্তি দেয়নি। বললাম, কোনোরকম পাপ সম্পর্কে আমি সচেতন নই; যা জানি তা হল ফৌজদারি অপরাধের জন্যে আমি অভিযুক্ত। এবং আমি সেই অপরাধের দাম দিচ্ছি এবং কারও অধিকার নেই আমার থেকে এর চেয়ে বেশিকিছু আশা করা।
ঠিক তখনই তিনি আবার দাঁড়ালেন, এবং দেখলাম, তিনি যদি এই ছোট্ট সেলে ঘোরাফেরা করতে চান, তবে তাকে শুধু বসতে হবে আর উঠতে হবে। মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। এক পা এগিয়ে এলেন তিনি, যেন কাছে আসতে ভয় পাচ্ছেন। তারপর শিকের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন।
‘বাবা, তুমি ভুল করছ’, গম্ভীরভাবে বললেন, “তোমার কাছে অনেক দাবি আছে। এবং হয়তো তা তোমার কাছে চাওয়া হবে।’
‘মানে?’
‘তোমাকে হয়তো দেখতে বলা হবে…’
‘কী দেখতে?’ আস্তে আস্তে তিনি আমার সেলের চারদিকে তাকালেন, এবং যখন কথা বললেন তখন তাঁর দুঃখিত স্বর শুনে অবাক হয়ে গেলাম।
‘আমি ভালো করে জানি, পাথুরে এই দেয়ালগুলি মানুষের দুঃখে আবৃত হয়ে আছে। অবিচল থেকে কখনও আমি এদিকে তাকাতে পারিনি। এবং তবুও–বিশ্বাস করো, আমি একেবারে মনের ভিতরে থেকে বলছি–তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে অধম সেও মাঝে মাঝে দেখেছে এই ধূসর দেয়ালের মাঝে এক দিব্যজ্যোতি মুখ ফুটে উঠছে। এই মুখটি দেখতেই তোমাকে বলা হচ্ছে।’
এবার একটু কৌতূহলী হলাম। বললাম, এই দেয়ালগুলির দিকে কয়েকমাস ধরে তাকিয়ে আছি; এবং আমি এদের যেভাবে চিনি সেভাবে পৃথিবীতে আর কেউ তাদের চেনে না। এবং মাঝে মাঝে, বোধহয়, আমি এখানে একটি মুখের সন্ধান করি। সেটি হল সূর্যের মতো সোনালি, কামনায় ভরা একটি মুখ–মারির মুখ। আমার কপাল খারাপ; আমি কখনও তা দেখিনি এবং তাই সে-চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি। এ ছাড়া তিনি যে ‘ফুটে ওঠার’ কথা বলছেন ঐ ধরনের কিছু এই ধূসর দেয়ালে ফুটে উঠতে আমি দেখিনি।
করুণভাবে তাকালেন তিনি আমার দিকে। দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসে ছিলাম আর কপালে এসে আলো আছড়ে পড়ছিল। বিড়বিড় করে তিনি কী বললেন, বুঝতে পারলাম না। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে তিনি চুম্বন করতে পারেন কি না। বললাম, ‘না।‘ তারপর তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন, দেয়ালের কাছে এলেন এবং আস্তে আস্তে সেখানে হাত বুলোলেন। ‘পার্থিব এইসব জিনিস কি তুমি এতই ভালোবাস?’ নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
কোনো উত্তর দিলাম না।
কিছুক্ষণ তিনি চোখ ফিরিয়ে রাখলেন। তার উপস্থিতি ক্রমেই বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। এবং তাঁকে প্রায় বলতে যাচ্ছিলাম চলে যেতে, আমাকে শান্তিতে থাকতে দিতে, কিন্তু হঠাৎ তিনি আমার দিকে ফিরে আবেগভরে বলতে লাগলেন :
‘না, না, আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিশ্চিত যে তুমি প্রায়ই ভেবে থাকো পরকাল বলে কিছু থাকুক।‘
নিশ্চয়, বললাম আমি। মাঝে মাঝে সবারই ঐ ধরনের ইচ্ছে জাগে। কিন্তু ধনী হতে চাওয়া, বা দ্রুত সাঁতার কাটতে চাওয়া, বা মুখের গড়ন ভালো হওয়া—এ-ধরনের ইচ্ছে থেকে এর বেশি গুরুত্ব নেই। এটা এগুলিরই সমগোত্র। আমি এ সূত্র ধরেই বলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু প্রশ্ন করে তিনি বাধা দিলেন। কবর দেয়ার পর আমার অবস্থা সম্পর্কে আমি কী ভেবেছি?
ধমকের সুরে বললাম, ‘যা জানি তা পার্থিব জীবন সম্পর্কেই জানি। এবং এতেই আমি সন্তুষ্ট।’ একটু থেমে বললাম, ‘যথেষ্ট হয়েছে।’
কিন্তু ঈশ্বর-বিষয়ে তার আরও কিছু বলার ছিল। তাঁর কাছে গিয়ে আমি শেষবারের মতো বোঝাতে চাইলাম, আমার সময় বেশি নেই এবং যেটুকু আছে সেটুকু আমি ঈশ্বরের পিছে নষ্ট করতে রাজি নই।
তারপর তিনি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে বললেন, পাদরি জেনেও কেন আমি তাঁকে ‘ফাদার’ বলে সম্বোধন করিনি। একথা আমাকে আরও বিরক্ত করে তুলল এবং বললাম, তিনি আমার পিতা তো ননই বরং বলতে গেলে তিনি আমার বিপক্ষের লোক।