এক্ষেত্রে, শুধুমাত্র এক্ষেত্রে বলতে গেলে, আমার অধিকার ছিল আরেকটি বিকল্প বিবেচনা করা, যে, আমার আপিল সফল হয়েছে। তার পরের সমস্যা ছিল, এজন্যে সমস্ত শরীরে যে-আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, যে-আনন্দ চোখের জলের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাকে শান্ত করা। অবশ্য নিজেকে শান্ত করার দায়িত্বটা নিজেরই; আর এই সম্ভাবনা চিন্তা করার সময়ও প্রথমটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে ভেবে রাখতাম। যখন দ্বিতীয়টি জিতে যেত তখন ঘণ্টাখানেক অন্তত মনটা শান্ত থাকত; এবং তাও কম কিছু নয়।
এ-সময় আমি আরেকবার পাদরির সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করলাম। শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম আকাশে একটা সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ছে, তার মানে গ্রীষ্মের বিকেল শেষ হয়ে এল প্রায়। এ-মুহূর্তে আমার আপিলকে আমি হারিয়ে দিয়েছি, অনুভব করছিলাম রক্তচলাচল পর্যন্ত মৃদু হয়ে গেছে। না, আমি পাদরিকে দেখতে। চাইনি…. তারপর আমি এমন কিছু করলাম যা বহুদিন করিনি অর্থাৎ মারির কথা। ভাবতে লাগলাম। অনেকদিন সে আমায় কিছু লেখেনি; মনে হল, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একটি লোকের রক্ষিতা হয়ে থাকা তার কাছে ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে। বা হয়তো তার অসুখ করেছে, বা মরে গেছে। এ-ধরনের কিছু যে ঘটতে পারে তা তো অস্বীকার করা যায় না। আমি কীভাবে জানব, যখন আমাদের দুটো শরীর ছাড়া, যা এখন পৃথক, আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, এমন কিছু নেই যা দিয়ে পরস্পরকে মনে করব? ধরা যাক তার মৃত্যু হয়েছে, তা হলে তার স্মৃতির কোনো। দাম নেই; মৃত একটি মেয়ে সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকবে না। এটা আমার কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হল; যেমন মনে হল আমি মরে গেলে সবাই আমার কথা ভুলে যাবে। অবশ্য এটাও বলতে পারি না যে জিনিসটা মেনে নেয়া কঠিন; সত্যিই এমন কোনো জিনিস নেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যা মেনে না নেয়।
যখন চিন্তাটা এই পর্যন্ত পৌঁছেছে তখন না-বলে পাদরি ঢুকলেন। তাঁকে দেখে চমকে না উঠে পারলাম না। তিনি যেভাবে তাড়াতাড়ি আমাকে ব্যস্ত হতে মানা করলেন তাতে বোঝা গেল আমার চমকে-ওঠা তার চোখ এড়ায়নি। তাকে মনে করিয়ে দিলাম এ-সময় তাঁর আসার কথা নয়; এবং এলেও চরম মুহূর্তের আগে আসেন। বললেন তিনি, এটা একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার; এর সঙ্গে আমার আপিলের কোনো সম্পর্ক নেই এবং যা তিনি কিছুই জানেন না। তারপর তিনি আমার বিছানায় বসলেন এবং আমাকে তার পাশে বসতে বললেন। আমি বসলাম না–এজন্যে নয় যে আমি তাকে অপছন্দ করছিলাম। বরং তাকে বেশ শান্তশিষ্ট এবং অমায়িক বলে মনে হল।
প্রথমে কিছুক্ষণ হাতদুটো হাঁটুর ওপর রেখে সেদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলেন। হাতদুটো, শীর্ণ শিরবহুল, যা আমাকে দুটো ছোট্ট চঞ্চল জন্তুর কথা মনে করিয়ে দিল। তিনি এতক্ষণ ধরে একইভাবে বসে রইলেন যে আমি প্রায় ভুলেই গেছিলাম যে তিনি এখানে আছেন।
হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি আমার চোখে চোখ রাখলেন।
‘কেন,’ বললেন তিনি, ‘আমাকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে দিতে দাওনি?’
বললাম, ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি না।
‘এ-বিষয়ে কি তুমি একেবারে নিশ্চিত?’
বললাম, এ-ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোনো প্রয়োজনীয়তা আমি দেখি না; আর আমার মতে, আমি বিশ্বাস করি বা না-করি তাতেও তাঁর তেমন কিছু আসে যায় না।
তিনি অতঃপর দেয়ালে হেলান দিয়ে হাতদুটো সমান করে জানুর ওপর রাখলেন। যেন আমাকে কিছু বলছেন না এমনভাবে তিনি বললেন, তিনি দেখেছেন, অনেকে অনেক বিষয় সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত, কিন্তু আসলে তা নয়। আমি নিশ্ৰুপ রইলে তিনি আবার আমার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন :
‘তুমি কি আমার সঙ্গে একমত নও?’
বললাম, এরকম হতে পারে। কিন্তু যদিও আমি জানি না কিসে কিসে আমার আগ্রহ তবুও কী কী আমাকে আগ্রহান্বিত করে না তা জোরগলায় বলতে পারি। এবং তিনি যে-প্রশ্ন তুলেছেন সে-সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।
ভঙ্গিবদল না করে আনমনা তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি দেখেই কি একথা বলছি? বললাম, হতাশ আমি হইনি, তবে ভয় পেয়েছি যা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
‘তা হলে’, বললেন তিনি দৃঢ়ভাবে, ‘ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করতে পারেন। যতজনকে আমি তোমার জায়গায় দেখেছি, বিপদের সময় তারা সবাই ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছে।’
অত্যন্ত স্বাভাবিক, বললাম আমি, তাদের ইচ্ছে হলে ঐরকম করার অধিকার তাদের আছে বইকি। আমার বেলায়, আমাকে সাহায্য করা হোক তা আমি চাই না। আর তা ছাড়া যে-বিষয়ে আমার আগ্রহ নেই সে-বিষয়ে সময় খরচ করার মতো সময়ও আমার নেই।
ক্রুদ্ধভাবে হাত নাড়লেন তিনি; বসে পোশাক ঠিক করলেন। তারপর আমাকে আমার বন্ধু’ বলে সম্বোধন করে আবার কথা শুরু করলেন বললেন। প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছি বলে তিনি আমার সঙ্গে ঐভাবে কথা বলছেন না। তাঁর মতে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি লোকের ওপর প্রাণদণ্ডাজ্ঞা ঝুলছে।
এখানে আমি বাধা দিলাম; বললাম, ব্যাপারটা এক নয় এবং এটা কোনো সান্ত্বনার কথাও নয়।
মাথা নাড়লেন তিনি, ‘হতে পারে, এখন না হোক, একদিন-না-একদিন তোমার মৃত্যু হবে। এবং ঠিক তখনও প্রশ্ন উঠবে। তখন তুমি কীভাবে সেই ভয়ানক শেষ সময়ের মুখোমুখি হবে?’
বললাম, এখন যেভাবে মুখোমুখি হয়েছি তখনও ঠিক একইভাবে মুখোমুখি হব।