তবুও, এটা মানতে হবে যে, একজনের পক্ষে সবসময় ঠিকভাবে চিন্তা করা সম্ভব নয়। আরেকটি হাস্যকর ভাবনা ছিল আমার, নতুন আইন তৈরি করে শাস্তি বিধান বদলে দেয়া। আমার মতে, আসলে যা প্রয়োজন তা হল অপরটাকে একটা সুযোগ দেয়া; সে যত সামান্যই হোক না কেন; ধরা যাক হাজারে একটি। এমন ওষুধ বা কয়েকটি ওষুধের সম্মিলনে একটি ওষুধ দরকার যা খেলে রোগী (তাকে আমি ‘রোগী’ হিসেবে ধরেছি) এক হাজারে নশো নব্বই বার মরবে। তাকে। জানতে হবে যে, এটার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। অনেক চিন্তা করে ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে গিলোটিনের একমাত্র দোষ হল, অপরাধী এতে কোনো সুযোগই পায় না, একেবারেই না। সত্যি বলতে কি, অপরিবর্তনীয়ভাবে রোগীর মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হয়। এটা আগে থেকে একটি স্থিরকৃত সিদ্ধান্ত। যদি কখনও হঠাৎ করে ছুরি ঠিকমতো কাজ না করে তা হলে তারা আবার সবকিছু শুরু করে। আমার মতে এটাই হল ক্রটি; এবং এই প্রেক্ষিতে আমার চিন্তা একেবারে ঠিক। আবার অন্যদিকে স্বীকার করে নিলাম, এটা সিস্টেমের দক্ষতাও প্রমাণ করে। ব্যাপারটা দাঁড়াল এরকম : দণ্ডপ্রাপ্ত লোকটি মানসিকভাবে সহযোগিতা করার জন্যে তৈরি থাকে, এবং তারই স্বার্থ চিন্তা করে সবকিছু নিখুঁতভাবে হওয়া উচিত।
আরেকটি জিনিস প্রমাণিত হল যে, এতদিন পর্যন্ত এ-বিষয়ে আমার ধারণা ছিল ভুল। কয়েকটি কারণে আমার ধারণা জন্মেছিল, গিলোটিনে শিরচ্ছেদের আগে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। খুব সম্ভব ১৭৮৯-এর বিপ্লব সম্পর্কে স্কুলে। যা পড়েছিলাম বা ছবি দেখে মনে হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই এ-ধারণা গড়ে উঠেছিল। একদিন সকালে, একটি ছবির কথা মনে হল যা পত্রিকাগুলো ছাপিয়েছিল এক কুখ্যাত অপরাধীর প্রাণদণ্ডের সময়। আসলে যন্ত্রটি থাকে মাটিতে এবং এটা তেমন চেয়ে দেখার মতো নয়। আর আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকে এটা অনেক বেশি অপ্রশস্ত। ভেবে অবাক লাগল ছবিটির কথা এতদিন আমার মনে হয়নি। সে-সময় আমাকে যা মুগ্ধ করেছিল তা হল গিলোটিনের ছিমছাম ভাব; বাইরের চকচকে ভাব এবং ফিনিশিং দেখে গবেষণাগারের যন্ত্রের মতো মনে হয়। যে যা জানে না তা সম্পর্কে তার অতিরঞ্জিত ধারণা থাকে। এখন। আমার মনে হল গিলোটিনে শিরচ্ছেদ অত্যন্ত সোজা; মানুষটির মুখোমুখি থাকে যন্ত্রটি এবং সে যখন তার দিকে হেঁটে যায় তখন মনে হয় সে পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। অবশ্য একদিক থেকে, এটাও হতাশাব্যঞ্জক। বলতে গেলে, পৃথিবীকে নিচে রেখে ফাঁসির মঞ্চে উঠে যাওয়া একটা অন্য ধরনের। ব্যাপার। কিন্তু এখানে, যন্ত্রটিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখছে; তারা তোমাকে হত্যা করছে অপদস্থ করার মনোভাব নিয়ে, দক্ষতার সঙ্গে।
আরও দুটি জিনিস নিয়ে আমি সবসময় ভাবছিলাম; ভোরবেলা এবং আমার আপিল। যাহোক, এসব চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলার জন্যে সবসময় চেষ্টা করতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকতাম এবং তা দেখতে নিজেকে বাধ্য করতাম। আলো যখন সবুজাভ হয়ে উঠত তখন বুঝতাম, রাত ঘনিয়ে আসছে। চিন্তাস্রোতকে আরেকদিকে ঘোরাবার জন্যে হৃদয়ের শব্দ শোনার চেষ্টা করতাম। আমি কোনোদিন ভাবিনি এই মৃদু স্পন্দন, যা এতদিন পর্যন্ত আমার সঙ্গে আছে। তা থেমে যাবে। কল্পনাপ্রবণতা কখনোই আমার প্রধান যুক্তি ছিল না। তবুও সেই মুহূর্তটিকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করতাম যে-মুহূর্ত থেকে হৃদয়ের স্পন্দন আর শোনা যাবে না। কিন্তু পারলাম না। ঘুরেফিরে সেই ভোরবেলা আর আপিলের। কথাই মনে হতে লাগল। বুঝে নিলাম, স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাধারাকে ভুলে থাকার জন্যে অন্য চিন্তার আশ্রয় নেওয়া বোকামি।
প্রতিদিন ভোরে তারা একজনকে নিতে আসত; আমি শুধু এটুকুই জানতাম। সুতরাং আমার প্রত্যেকটি রাতই সেই একটি ভোরের অপেক্ষায় কাটত। আমাকে অবাক করে দেওয়া হবে, এটা আমার কখনোই পছন্দ নয়। যা ঘটবে তার জন্যে আমি প্রস্তুত থাকতে চাই। সুতরাং দিনের বেলায় ঘুমোবার অভ্যাস করে নিয়ে সারারাত জেগে অপেক্ষা করতাম, ওপরের অন্ধকার গম্বুজের মাথায় ভোরের প্রথম আলো দেখার জন্যে। রাতের সবচেয়ে বাজে সময় ছিল তখন, যখন তারা আসত; দুপুর-রাতের পর আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কিছু শোনার চেষ্টা করতাম। এর আগে কখনও আমার শ্রবণশক্তি এত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠেনি, এখন সামান্য একটু শব্দ হলেই টের পেতাম। তবু বলব, একদিক থেকে আমি। ভাগ্যবান। কারণ ঐ সময় কখনও পায়ের শব্দ আমার দিকে এগিয়ে আসেনি। মা। বলতেন, শত দুঃখের সময়ও একটুখানি আশার আলো থাকে। এবং প্রত্যেকদিন। সকালে যখন আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠত, আলোর বন্যায় আমার সেল ভরে যেত, তখন আমি তার সঙ্গে একমত হতাম। যখন আমি পায়ের শব্দ শুনতে পেতাম তখন আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হত। একটুখানি মৃদু শব্দও আমাকে দরোজার কাছে নিয়ে যেত, এবং রুক্ষ ঠাণ্ডা কাঠের গায়ে একাগ্রভাবে কান চেপে ধরতাম, ক্লান্ত কুকুরের দ্রুত এবং কর্কশ নিশ্বাসের শব্দের মতো নিজের নিশ্বাসের শব্দ কানে। বাজত। কিন্তু একসময় তাও শেষ হত; হৃৎকম্প থেমে যেত এবং আমি জানতাম আরও চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে আমি বেঁচে গেলাম।
তারপর সারাটা দিন পরে থাকত আপিলের চিন্তা করার জন্যে। হতাশ যাতে না হতে হয় সেজন্যে ফলাফল থেকে শুরু করে সবকিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে ভাবতাম। শুরু করতাম খারাপ দিক ভেবে যে আমার আপিল বাতিল হয়ে গেছে। তার মানে অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। স্বভাবতই অন্যদের থেকে আগে। ‘কিন্তু নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতাম, এটা তো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার যে জীবনে বেঁচে থেকে লাভ নেই। বিস্তৃতভাবে চিন্তা করে দেখলাম, ত্রিশ বছর বেঁচে থাকা বা তিন কুড়ি বছরে মরে যাওয়ার মধ্যে খুব বেশি একটা পার্থক্য নেই– কারণ, দুক্ষেত্রেই অন্যান্য মানুষ-মানুষীরা বেঁচে থাকবে, পৃথিবী আগের মতো চলবে। সুতরাং আমি এখন মারা যাই বা চল্লিশ বছর পর মারা যাই, একবার-না একবার আমাকে অবশ্যই এই মৃত্যু-ব্যাপারটার মুখোমুখি হতে হবে। তবুও এ ধরনের চিন্তায় যে-ধরনের সান্ত্বনা পাওয়া দরকার সেরকম সান্ত্বনা পেতাম না; আরও কতগুলি বছর হাতে থাকতে পারত–এ-চিন্তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে চোখে। ভেসে উঠত। তবুও এভাবে সান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করতাম যে, যদি আমার দিন ফুরিয়ে যেত, মৃত্যু এসে দাঁড়াত দরোজায় তখন আমার মনের অবস্থা কেমন হত। যখন কেউ মৃত্যুর মুখোমুখি হয় তখন মৃত্যুর সঠিক ধরন প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে–সেজন্য ওর কাছে পৌঁছানোর বিতর্কের তন্তুজাল হারিয়ে ফেলা কঠিন নয়–আপিল যে প্রত্যাখ্যাত হবে সেজন্যে আমার তৈরি থাকা উচিত।