বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা, বলতে গেলে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। তারপর ঘণ্টা বেজে উঠল। আমার উকিল আমাকে ছেড়ে যাবার আগে বললেন, ‘জুরিদের মুখপাত্র উত্তর পড়ে শোনাবেন। তারপর রায় শোনার জন্য তোমাকে ডাকা হবে।’
শব্দ করে কয়েকটি দরজা বন্ধ হল। সিঁড়িতে শুনলাম দ্রুতপায়ের শব্দ কিন্তু তা দূরে না কাছে বুঝতে পারলাম না। তারপর আদালত-কক্ষে মৃদু একটি গলার আওয়াজ শুনলাম।
আবার ঘণ্টা বেজে উঠলে আমি কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম, আদালতের নীরবতা আমাকে ঘিরে ধরল এবং এই নীরবতার সঙ্গে সঙ্গে মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগল যখন দেখলাম এই প্রথমবারের মতো তরুণ সাংবাদিকটি আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিল। মারির দিকে আমি তাকালাম না। অবশ্য তাকাবার সময়ও ছিল না, কারণ এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি তার রায় পড়া শুরু করেছেন; বললেন তিনি : ‘ফরাসি জনগণের নামে’ কোনো-এক প্রকাশ্য জায়গায় আমার শিরচ্ছেদ করা হবে।
সে-সময় আমার মনে হল দর্শকদের চোখের ভাষা আমি বুঝতে পারছি; তা হল প্রায় এক সম্মানজনক সহানুভূতি। এমনকি পুলিশটিও খুব আস্তে আমায় স্পর্শ করল। উকিল ভদ্রলোক আমার কবজিতে হাত রাখলেন। চিন্তা করা তখন আমি একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। শুনলাম, বিচারপতি জিজ্ঞেস করছেন আমার আরও কিছু বলার আছে কি না। কয়েক মুহূর্ত চিন্তার পর বললাম, ‘না।’ এরপর পুলিশ দুজন আমাকে বাইরে নিয়ে এল।
.
৫.
এইমাত্র তৃতীয়বারের মতো আমি জেলখানার পাদরির সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করলাম। তাঁকে বলার মতো আমার কিছুই নেই, কথা বলার ইচ্ছেই আমার নেই–আর তা ছাড়া কয়েকদিন পর তো তার সঙ্গে আরও ঘনঘন দেখা হবে। মনে আমার এখন একটিই চিন্তা : ভবিতব্য এড়াবার কোনো-একটি ফাঁক খুঁজে বের করা।
আমাকে অন্য একটি সেলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখানে শুয়ে আকাশ দেখা ছাড়া দেখার মতো আর কিছু নেই। দিন রাতের দিকে এগোয় আর আমার পুরো সময়টা আকাশের রং বদলানো দেখে কাটে। মাথার নিচে হাত রেখে তাকিয়ে থাকি আর অপেক্ষা করি।
কৌশল আবিষ্কারের চিন্তা মন অধিকার করে রাখে; সবসময় ভাবি, শেষমুহূর্তে ন্যায়বিচারের নিষ্ঠুর যন্ত্র থেকে কেউ পালাতে পেরেছে কি না বা শিরচ্ছেদের ঠিক পূর্বমুহূর্তে অব্যাহতি পেয়েছে কি না। বারবার নিজেকে দোষ দিই, কেন কখনও প্রকাশ্য প্রাণদণ্ডের দিকে নজর দিইনি। এসব ব্যাপারে আগ্রহ থাকা উচিত। কখন যে কার কী প্রয়োজন হয় তা কেউ বলতে পারে না। অন্যান্য অনেকের মতো আমিও কাগজে শিরচ্ছেদের বিবরণ পড়েছি। কিন্তু এ-বিষয়ে নিশ্চয় কোনো টেকনিক্যাল বই আছে; শুধুমাত্র আমিই সেসবের দিকে কখনও আগ্রহ দেখাইনি। এইসব বইয়ে নিশ্চয়ই পালিয়ে যাওয়ার গল্প পেতাম। নিশ্চয় এর যে-কোনো গল্পে দেখতাম চাকা যে-কোনোভাবে হোক থেমে গেছে; একবার, মাত্র একবার নিশ্চয়ই যে-কোনো গল্পে দেখতাম ঘটনাপ্রবাহের মাঝে এড়িয়ে যাবার একটি পথ খুঁজে পাওয়া গেছে। শুধু একবার! একটিমাত্র উদাহরণই আমাকে সন্তুষ্ট করত। বাকিটা নিজের কল্পনা দিয়ে ভরে নিতাম। পত্রিকাগুলো প্রায়ই একটা ব্যাপারে কচকচি করে, তা হল– ‘সমাজের নিকট ঋণ’–যে-ঋণ, তাদের মতে, অপরাধীদের পূরণ করতে হবে। এ-ধরনের কথা কল্পনাকে উজ্জীবিত করে না। না, যে-চিন্তাটা মনে তোলপাড় করছিল, তা হল এক আঘাতে তাদের রক্তপিপাসু যজ্ঞ চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া; মুক্তির জন্যে পাগলের মতো পলায়ন যা জুয়ারির শেষ তাসের মতো আমাকে একবার একমুহূর্তের জন্যে হলেও সেই সুযোগ করে দেবে, কিন্তু সেই সুযোগ’ শেষ হত রাস্তার একপাশে ভূতলশায়ী হয়ে অথবা পিঠে গুলি খেয়ে। কিন্তু এসব পরিণামের কথা ভেবেও এই চিন্তা ছিল বিলাসিতা; কারণ আমি ইঁদুর-ধরা কলে আটকা পড়ে গেছি।
চেষ্টা করেও আমি এই নির্দয় নিশ্চয়তাকে মন থেকে তাড়াতে পারলাম না। একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, যার ওপর ভিত্তি করে রায় দেওয়া হয়েছে এবং রায় দেওয়ার ঠিক পরপরই যেসব ঘটনাপ্রবাহের শুরু, তার মধ্যে পার্থক্য আছে। রায় দেওয়ার কথা ছিল পাঁচটায়, তার বদলে রায় ঘোষণা করা হল আটটায়, তার মানে এর মধ্যে অন্য কোনো পরিবর্তন হওয়া ছিল সম্ভব, এবং এই রায় দিয়েছেন তাঁরা, যাঁরা নিজেদের স্বরূপও বদলাতে পারেন এবং শুধু তা-ই না, নিজেদের জাহির করেছেন ;ফরাসি জনগণের’ হয়ে–চীনা বা জার্মানরা কী দোষ করল?–এ সমস্তকিছু আদালতের রায়কে প্রভাবান্বিত করেছে, তার গাম্ভীর্য নষ্ট করেছে। তবুও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, যে-মুহূর্তে রায় ঘোষণা করা হল সে-মুহূর্ত থেকে এর ফলাফল এত অনিবার্য, এত বাস্তব হয়ে উঠল যে, উদাহরণস্বরূপ বলতে হয়, যে-দেয়ালের পাশে শুয়ে আছি সে-দেয়াল যেন আমায় পিষে মারছে।
যখন এসব ভাবছি তখন বাবার সম্পর্কে মা’র বলা একটি গল্প মনে পড়ল। বাবাকে আমি কখনও দেখিনি। মা আমাকে তার সম্পর্কে যা বলেছিলেন আমি শুধুমাত্র তা-ই জানতাম। এর মধ্যে একটি গল্প হল, তিনি একবার এক খুনির প্রাণদণ্ড দেখতে গিয়েছিলেন। অবশ্য এটা চিন্তা করলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কিন্তু ঘটনাটি তিনি পুরোপুরি দেখেছিলেন এবং বাড়িতে ফিরে এসে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সে-সময় বাবার ঐ আচরণ আমার কাছে খুব। ন্যক্কারজনক মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। তখন বুঝতে পারিনি প্রাণদণ্ডের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই; একদিক থেকে দেখতে গেলে সত্যিকারভাবে একমাত্র এটাই একজন মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। ঠিক করলাম, যদি কারাগার থেকে মুক্তি পাই তা হলে আমি প্রত্যেকটি প্রাণদণ্ড দেখতে যাব। এমনই বোকা ছিলাম আমি যে এই কথা কখনও ভাবিনি। একমুহূর্তের জন্যে চিন্তা করলাম, আমি মুক্ত, দুসারি পুলিশের পিছে দাঁড়িয়ে আছি, একেবারে ঠিক জায়গায় নিজেকে একজন দর্শক হিসেবে চিন্তা করলাম, যে শুধু প্রাণদণ্ডদান দেখতে এসেছে এবং যে বাসায় ফিরে বমি করবে– এ-চিন্তা আমার মন এক অদ্ভুত বন্য উল্লাসে ভরে তুলল। এ-ধরনের চিন্তা করা বোকামি হয়েছিল; কারণ একটু পরেই যেন ঠাণ্ডায় শরীর শিউরে উঠল, ভালোভাবে নিজেকে কম্বলে জড়িয়ে নিলাম; কিন্তু দাতে ঠকঠক করা কিছুতেই থামানো গেল না।