যাহোক, আমার উকিলকে এতটা দুর্বল মনে হচ্ছিল যে তা প্রায় হাস্যকর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তিনি খুব উত্তেজিতভাবে তাড়াহুড়ো করে প্রতিপক্ষের জবাব দিলেন এবং আমার আত্মা সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। কিন্তু আমার মনে হল সরকারি উকিল তার থেকে ঢের বেশি বুদ্ধিমান। ‘আমিও’, বললেন তিনি, এই লোকটির আত্মা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছি, কিন্তু যেক্ষেত্রে বিপক্ষে আমার জ্ঞানী বন্ধু কিছু খুঁজে পাননি সেক্ষেত্রে আমি কিছু খুঁজে পেয়েছি। সত্যি বলতে কি অপরাধীর মনটাকে আমি খোলা বইয়ের মতো। পড়েছি।’ তিনি যা পড়েছেন তা হল, আমি একজন চমৎকার যুবক, স্থিরবুদ্ধি ধর্মভীরু কর্মচারী, পরিচিত মহলে আমি ছিলাম জনপ্রিয়, যে-কারও বিপদে সহানুভূতিশীল। তাঁর মতে আমি দায়িত্ববান পুত্র এবং যতদিন পেরেছি ততদিন মাকে দেখেছি। এবং বহুদিন উদ্বেগে কাটাবার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে, মাকে আমি ঘরে যে-আয়েশ দিতে পারব না, আশ্রমে গেলে তিনি তা পাবেন। ‘ভদ্রমহোদয়গণ’, যোগ করলেন তিনি, ‘আমার জ্ঞানী বন্ধু এই আশ্রমের উদ্দেশে যা বলেছেন তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি। আশ্রমের উৎকর্ষ প্রমাণের দরকার নেই। আমাদের মনে রাখলেই চলবে যে, এর উন্নতিকল্পে সরকারি একটি বিভাগ টাকা ঢালছে।‘ লক্ষ করলাম, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি কিছু বললেন যা আমার কাছে মারাত্মক ক্রটি বলে মনে হল। কিন্তু সারাদিন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা আমার ‘আত্মা’ নিয়ে এত কচকচি করলেন যে আমার কাছে সব ফাঁকাফকা ঠেকতে লাগল। মনের মধ্যে সবকিছু ধূসর পাণ্ডুর হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল।
একটি ঘটনা শুধু ব্যতিক্রম; শেষের দিকে আমার উকিল যখন এলোমেলো কথা বলছিলেন তখন হঠাৎ রাস্তা থেকে একজন আইসক্রিমঅলার টিনের শিঙা শোনা গেল। কথার তরঙ্গ ভেদ করা মৃদু তীক্ষ্ণ এক শব্দ। তখনই একরাশ স্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলল সেইসব দিন যা আর এখন আমার নয়, যা থেকে আমি স্বাভাবিক সাধারণ আনন্দ পেয়েছিলাম–গ্রীষ্মের সুগন্ধ, প্রিয় রাস্তাঘাট, বিকেলের আকাশ। মারির পোশাক এবং হাসি। এখানে যা ঘটছিল তার নিরর্থকতা আমার টুটি চেপে ধরছিল, ইচ্ছে করছিল বমি করি; একটি ইচ্ছেই তখন ঘুরেফিরে মনে এল–সেলে ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া…শুধু ঘুম।
অস্পষ্টভাবে শুনলাম, আমার উকিল শেষবারের মতো আবেদন করছেন। ‘জুরি মহোদয়গণ, এক দুঃখজনক মুহূর্তে সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে যা করেছে তার জন্যে নিশ্চয় আপনারা এই কর্মঠ, ভদ্র যুবকটিকে মৃত্যদণ্ড দেবেন না! এজন্যে আজীবন তার যে মনস্তাপ রয়ে যাবে তা-ই কি তার শাস্তির জন্যে যথেষ্ট নয়? আমি দৃঢ়চিত্তে আপনাদের সেই রায়ের জন্যে অপেক্ষা করব যে-রায় অপরাধের গুরুত্বকে লঘু করে দেখবে।’
আদালতের কাজ শেষ হল এবং আমার উকিল বসে পড়লেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাঁর কিছু সহকর্মী কাছে এসে তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন। আবার তুমি একটা খেল দেখালে বটে।’ একজনকে আমি বলতে শুনলাম। আরেকজন আইনজীবী আমাকে সাক্ষী মেনে বললেন, ‘চমৎকার হয়েছে, তা-ই না?’ কথাটা স্বীকার করলাম কিন্তু আন্তরিকভাবে নয়। ব্যাপারটা কি চমৎকার হয়েছে বা অন্যরকম হয়েছে তা বিচার করার মতো শক্তি আমার ছিল না।
এরইমধ্যে দিন ফুরিয়ে আসছিল। গরমও কমতে লাগল। রাস্তা থেকে যে শব্দ ভেসে আসছিল তাতে বুঝলাম সন্ধ্যার স্নিগ্ধতা নেমে আসছে। আমরা সবাই। বসে ছিলাম, অপেক্ষা করছিলাম। অবশ্য যেজন্যে অপেক্ষা করছিলাম তার জন্যে আমি ছাড়া কারও উদ্বিগ্ন হবার কথা নয়। আদালত-কক্ষের চারদিকে তাকালাম। প্রথমদিনের মতোই সব ঠিকঠাক। ধূসর পোশাক পরা সাংবাদিক এবং রোবট- মহিলাটির সঙ্গে চোখাচোখি হল। তাতে মনে পড়ল শুনানি চলাকালীন মারির চোখে চোখ রাখতে আমি একবারও চেষ্টা করিনি। এ নয় যে আমি তাকে ভুলে গেছিলাম, আসলে আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। এখন দেখলাম তাকে, সেলেস্তে এবং রেমন্ডের মাঝে বসে আছে। আমাকে দেখে সে একটু হাত নাড়ল, যেন বলতে চাইল, যাক তা হলে!’ হাসছিল সে, কিন্তু আমি জানি বেশ উদ্বিগ্ন সে। কিন্তু আমার হৃদয় যেন পাথর হয়ে গেছে, তার হাসির জবাবটা পর্যন্ত আমি দিতে পারলাম না।
বিচারপতিরা তাঁদের আসনে ফিরে এলেন। একজন খুব তাড়াতাড়ি জুরিদের উদ্দেশে কিছু প্রশ্ন পড়ে গেলেন। মাঝে মাঝে দুএকটা কথা বুঝতে পারলাম, যেমন শক্রতাবেশে হত্যা-প্ররোচনা, অপরাধের গুরুত্ব লঘু করা…। জুরিরা বাইরে। চলে গেলেন এবং আমাকে সেই ঘরটায় নিয়ে যাওয়া হল যেখানে আগেও আমি অপেক্ষা করেছি। আমার উকিল আমাকে দেখতে এলেন; যদিও খুব কথা বলছিলেন তবুও আগের থেকে বেশি দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা দেখালেন। আশ্বাস দিয়ে আমাকে বললেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এবং আমি হয়তো কয়েক বছরের বন্দিজীবন অথবা নির্বাসনের পর ছাড়া পেয়ে যাব। জানতে চাইলাম, শাস্তি বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা কীরকম। তিনি বললেন যে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি আইনের কোনো প্রশ্ন তোলেননি, কারণ এটা জুরিদের মন ঘুরিয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া টেকনিক্যাল ভিত্তি ছাড়া একটা দণ্ডাজ্ঞা বাতিল করা খুবই অসুবিধাজনক। আমি তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারলাম এবং মেনে নিলাম। নিরপেক্ষভাবে ব্যাপারটা ভেবে আমি তার কথা মেনে নিলাম। এছাড়া মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার কোনো পথ নেই। ‘যাহোক’, উকিল বললেন, ‘তুমি পুনর্বিচারের জন্যে সাধারণভাবে আবেদন করতে পারো। কিন্তু আমার মনে হয় জুরিদের রায় সন্তোষজনক হবে।’