তিনি বললেন, খুব সতর্কতার সঙ্গে এটা তিনি পরীক্ষা করেছেন এবং যা দেখেছেন তা সারশূন্য; ‘বলতে গেলে কিছুই না, জুরিমহোদয়গণ।’ সত্যিই, তিনি বললেন, আমার আত্মা নেই। মানবিকতা বলতে কোনো পদার্থ আমার মধ্যে নেই। স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে যেসব সদ্গুণাবলি থাকে তার কোনোটাই আমার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘’সন্দেহ নেই।’ যোগ করলেন তিনি, এ-ব্যাপারে আমি তার নিন্দা করব না। একজনের পক্ষে যা অর্জন করা সম্ভব নয়, তার সেই শক্তিহীনতার জন্যে নিন্দা করা উচিত নয়। ফৌজদারি আদালতে সহনশীলতার নিষ্ক্রিয় আদর্শকে জায়গা দিতেই হবে ন্যায়ের কঠোর উচ্চতর আদর্শের কাছে। বিশেষ করে এটা প্রযোজ্য, আপনাদের সামনে যে-ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে আছে তার বেলায়, যার নেই কোনো সদ্গুণাবলি এবং যে সমাজের জন্যে হুমকিস্বরূপ।’ এরপর তিনি মা’র প্রতি আমার ব্যবহারের কথা তুললেন এবং শুনানির সময় যা বলেছিলেন তা-ই বারবার উল্লেখ করতে লাগলেন। কিন্তু আমার অপরাধ সম্পর্কে তিনি এত বেশি বললেন যে আমি সব সূত্র হারিয়ে ফেললাম, তখন শুধুমাত্র আমি ক্রমাগত বেড়ে-ওঠা তাপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিলাম।
একসময় সরকারি উকিল থামলেন এবং খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর, খুব নিচু কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, এই একই আদালত আগামীকাল আরেকটি ঘৃণ্য মামলা, পিতৃহত্যার বিচার করবে।’ তাঁর কাছে এমন অপরাধ অকল্পনীয়। তবে তিনি নিশ্চিত যে, ন্যায়বিচারে কোনো সংশয় থাকবে না। তবুও, তিনি সোজাসুজিভাবে বলতে পারেন পিতৃহত্যা তাঁর মনে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, আমার নির্দয়তা সেই আতঙ্ককে ম্লান করে দিয়েছে।
‘যে তার পিতাকে হত্যা করেছে তার মতো এই লোকটিও সমাজে উপযুক্ত নয় যে তার মা’র মৃত্যুর জন্যে নৈতিকভাবে দায়ী। এবং একটি অপরাধ সৃষ্টি করেছে আরেকটি অপরাধের। আমাকে যদি বলতে বলা হয় তা হলে বলব দুজন অপরাধীর প্রথমজন, যিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, একটি নজির স্থাপন করেছিলেন, এবং দ্বিতীয় অপরাধটিকে অনুমোদন করেছেন। ভদ্রমহোদয়গণ, আমি এ-ব্যাপারে নিশ্চিত’–এখানে তিনি গলা উঁচু করলেন—’আমি যদি বলি আগামীকাল যে হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে তার জন্যেও এই লোক দোষী তা হলে অতিরঞ্জন করা হবে না। সুতরাং আশা করি আপনারা সে-অনুযায়ী রায় দেবেন।‘
সরকারি উকিল মুখের ঘাম মুছবার জন্যে আবার থামলেন। তারপর ব্যাখ্যা করে বললেন, বেদনাদায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার কর্তব্য সম্পন্ন করতে দ্বিধাবোধ করবেন না। ‘আমি আবার বলছি, এই লোকটির সে-সমাজে কানো স্থান নেই যে সমাজের মৌল নীতিগুলিকে সে অনুতাপহীনভাবে বিদ্রূপ করে। আর সে যেরকম হৃদয়হীন তাতে অনুকম্পা পাবার কোনো অধিকারও তার নেই। আমি তাকে আইনের চরম শাস্তি দেয়ার জন্যে আপনাদের অনুরোধ করছি; এবং এ অনুরোধ করছি একেবারে মন থেকে। আমার দীর্ঘদিনের কর্মজীবনে প্রায়ই আমাকে কর্তব্যের খাতিরে গুরুদণ্ড দেয়ার অনুরোধ করতে হয়েছে। কিন্তু এ-মামলা ছাড়া আর-কোনো মামলার ব্যাপারেই আমি এমন দ্বিধাহীনভাবে অনুরোধ করিনি। আমি এই হত্যাকাণ্ডের রায় দাবি করছি, কিন্তু এর গুরুত্ব যেন খাটো না করা হয়, এবং এক্ষেত্রে আমি শুধু আমার বিবেকের নির্দেশ এবং পবিত্র কর্তব্যকেই অনুসরণ করছি না, অনুসরণ করছি আমার স্বাভাবিক এবং চরম ঘৃণাকে যা মানবিক অনুভূতির ক্ষুদ্রতম কণাবর্জিত এই অপরাধীকে দেখলেই আমি অনুভব করি।‘
সরকারি উকিল বসে পড়লে দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল। ব্যক্তিগতভাবে, গরম এবং বিমূঢ় হয়ে যা শুনছিলাম তা আমাকে কাবু করে দিয়েছিল। প্রধান বিচারক মৃদু কেশে, খুব নিচুস্বরে জানতে চাইলেন আমার কিছু বলার আছে কি না। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং কথা বলার মতো মনের অবস্থা ফিরে এলে, প্রথম যে-কথাটি মনে এল তা-ই বলে ফেললাম, আরবদের হত্যা করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। উত্তরে তিনি বললেন, আদালত এই বক্তব্য বিবেচনা করে দেখবে। তবে, আমার উকিল আদালতে তাঁর বক্তব্য পেশ করার আগে, আমি যদি হত্যার কারণগুলি বলি তা হলে তিনি খুশি হবেন। তার স্বীকার করতে বাধা নেই যে এখন পর্যন্ত আমার পক্ষ সমর্থনের ভিত্তি তিনি পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারেননি।
ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইলাম যে, সূর্যের আলোর জন্যেই ঘটনাটা ঘটেছিল। কিন্তু আমি খুব তাড়াতাড়ি কথা বলছিলাম যার জন্যে কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। আর পরে বুঝলাম যে, সবকিছু অর্থহীন শোনাবে এবং সত্যি বলতে কি, দেখলাম, সবাই মুখ টিপে হাসছে।
আমার উকিল কাঁধ ঝাঁকালেন। এরপর বক্তব্য পেশ করার জন্যে তাঁর পালা এল। কিন্তু তিনি শুধু সময়ের অপর্যাপ্ততার কথা তুলে আগামী দুপুর পর্যন্ত আদালত মুলতবি রাখার অনুরোধ জানালেন। বিচারকও রাজি হলেন।
পরদিন আমাকে যখন আবার আদালতে নিয়ে আসা হল তখন তাপ কমাবার জন্যে বৈদ্যুতিক পাখাগুলো চলছিল আর জুরিরাও তাদের জমকালো ছোট পাখাগুলো ধীরলয়ে দোলাচ্ছিলেন। আমার পক্ষ সমর্থন করে যে-বক্তৃতা দেওয়া হল মনে হল তা যেন আর ফুরাবে না। অবশ্য, একসময় কান খাড়া করলাম, যখন শুনলাম তিনি বলছেন, ‘এটা সত্যি যে আমি একজন মানুষকে খুন করেছি।‘ তিনি একই উদ্যমে বলে চললেন। আমাকে বোঝাতে তিনি ‘আমি’ বলছিলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে এত অদ্ভুত ঠেকল যে, ডানদিকের পুলিশটির দিকে ঝুঁকে তাকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে বললাম। সে আমাকে চুপ করতে বলল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ওরা সবাই এরকম করে।‘ আমার মনে হল এর পিছনে যে-উদ্দেশ্য কাজ করছে তা হল, আমার বদলে উকিলকে দাঁড় করিয়ে, আমাকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া। আমাকে একেবারে সবকিছুর বাইরে রাখা। যাহোক, এতে তেমন কিছু আসে যায় না; কারণ তখন নিজেকে মামলার একঘেয়ে কার্যক্রম এবং অন্যান্য সবকিছু থেকে দূরে মনে হচ্ছিল।