.
৪.
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের সম্পর্কে কোনো আলোচনা শোনা যে খুবই মজার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং আমার উকিল ও সরকারি উকিল তাঁদের ভাষণে আমার অপরাধ থেকে আমার সম্পর্কেই বেশি বলেছেন।
অবশ্য দুজনের ভাষণে খুব-একটা তফাত ছিল না। আসামিপক্ষের উকিল স্বর্গের দিকে হাত তুলে দোষ স্বীকার করলেন, কিন্তু সেইসঙ্গে অপরাধের লঘুত্ব প্রমাণ করার জন্য যুক্তিও প্রদর্শন করলেন। সরকারি উকিলও একই ইঙ্গিত করলেন, তিনি স্বীকার করলেন যে আমি দোষী কিন্তু আমার অপরাধ যে লঘু সেটা অস্বীকার করলেন।
বিচারের এই পর্যায়টা ছিল খানিকটা বিরক্তিকর। প্রায়ই, তাঁদের তর্কাতর্কি শুনে আমার নিজের দুএকটি কথা বলতে ইচ্ছে হত। কিন্তু আমার উকিল এ-ব্যাপারে আমাকে আগেই বারণ করে দিয়েছিলেন। আমাকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, কথা বলে মামলার ক্ষতি কোরো না। সত্যি বলতে কি আমার মনে হচ্ছিল, সম্পূর্ণ বিচারক্রম থেকে আমাকে বাদ দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে; আমার নিজের বলার কিছু থাকবে না অথচ এদিকে আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হত বলি, যদিও সে ইচ্ছে সংবরণ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন : ‘শিকেয় তুলে রাখো সব, আমি জানতে চাচ্ছি এখানে কার বিচার হচ্ছে? একজনকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা তার জন্যে খুবই মারাত্মক ব্যাপার। এবং তোমাদেরকে বলার মতো সত্যিই আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে।’
অবশ্য, পরে মনে হল, বলার মতো আমার কিছুই নেই। যাহোক, আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে নিজের সম্বন্ধে কোনো আলোচনা শোনার পর আর সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ থাকে না। বিশেষ করে সরকারি উকিলের বক্তৃতা অর্ধেক শেষ হবার আগেই আমি বিরক্তি বোধ করতাম। শুধু বক্তৃতার কিছু অংশ, তাঁর ভাবভঙ্গি এবং প্রচুর নিন্দাবাদ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল–কিন্তু এগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা।
আমি যা ধারণা করেছিলাম তা হল, তিনি দেখাতে চাচ্ছেন যে অপরাধটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। মনে পড়ে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘জুরি মহোদয়গণ, আগগোড়া আমি ব্যাপারটাকে প্রমাণ করতে পারি। প্রথমত অপরাধ সম্পর্কে আপনারা সমস্ত প্রমাণাদি পেয়েছেন যা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এবং এরপর আপনারা মামলার, যা আমার মতে অন্ধকার দিক অর্থাৎ অপরাধীর ঘৃণ্য মানসিকতা সম্পর্কেও জানতে পেরেছেন।’
মায়ের মৃত্যু থেকে তারপর যা ঘটেছে সবকিছুর একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিয়ে। তিনি শুরু করলেন। আমার হৃদয়হীনতা, মা’র বয়স বলতে না-পারা, সুইমিং পুলে যাওয়া যেখানে মারির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, দুপুরে ফার্নান্ডেল অভিনীত ছবি দেখতে যাওয়া, সবশেষে মারিকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে আসা সবকিছুর ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করলেন। প্রথমে আমি তার কথা ধরতে পারিনি, কারণ তিনি বারবার বন্দির রক্ষিতা’ শব্দটি ব্যবহার করছিলেন অথচ সে ছিল আমার কাছে শুধু মারি। এরপর তিনি এলেন রেমন্ডের ব্যাপারে। আমার মনে হল, পুরো ব্যাপারটা তিনি এমনভাবে বর্ণনা করছিলেন যাতে তাঁর ধূর্ততা প্রকাশ পাচ্ছিল। তার সব কথাই মনে হচ্ছিল বিশ্বাসযোগ্য। রেমন্ডের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আমি তার রক্ষিতাকে চিঠি লিখেছিলাম যাতে সে রেমন্ডের ঘরে আসে এবং কুখ্যাত একজন লোকদ্বারা নিপীড়িত হতে পারে। তারপর সৈকতে রেমন্ডের শক্রদের সঙ্গে আমি ঝগড়া বাধিয়েছিলাম, যার পরিণামে রেমন্ড আহত হয়েছিল। আমি তার রিভলবার চেয়ে তা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আবার গিয়েছিলাম ফিরে। তারপর আমি লোকটিকে গুলি করেছি। প্রথমবার গুলি ছোঁড়ার পর আমি অপেক্ষা করেছি। তারপর কাজটা যাতে ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন হয় সেজন্যে ঠাণ্ডামাথায়, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামনাসামনি আরও চারটি গুলি ছুঁড়েছি।
‘এই আমার বক্তব্য’, বললেন তিনি, ‘আমি আপনাদের কাছে সেই ঘটনাগুলো তুলে ধরলাম যা নিহত ব্যক্তিকে হত্যার জন্যে এই লোকটিকে প্ররোচিত করেছিল। এবং সে যা করতে যাচ্ছিল তা সম্পর্কে ছিল সে সম্পূর্ণ সচেতন। এই ব্যাপারটিতে আমি গুরুত্ব আরোপ করছি। এই হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি যার জন্যে অপরাধের গুরুত্ব লঘু করা যেতে পারে। জুরি মহোদয়গণ, আমি আপনাদের মনে রাখতে বলব যে, অপরাধী একজন শিক্ষিত লোক। তিনি যেভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন তা আপনারা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন। তিনি খুব বুদ্ধিমান তাই মেপে কথা বলেছেন। আমি আবার বলছি, এটা কোনোরকমে মেনে নেওয়া যায় না যে, যখন তিনি অপরাধ করেছিলেন তখন তার গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না।
লক্ষ করলাম তিনি আমার ‘বুদ্ধিমত্তা’র ওপর জোর দিলেন। এটা ভেবে অবাক হলাম, যে-জিনিসটা একজন সাধারণ মানুষের গুণ বলে বিবেচিত হয় সেই একই জিনিস এখন একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে তার অপরাধের প্রমাণ হিসাবে। যখন এ-ব্যাপারে ভাবছিলাম, তখন তিনি কী বললেন তা ধরতে পারলাম না। এরপর শুনলাম তিনি ক্রুদ্ধভাবে চিৎকার করে বলছেন : ‘তাঁর সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধের জন্যে কি তাঁকে একবারও অনুতাপ করতে দেখা গেছে? একটি কথাও? না। বিচার চলাকালীন এই ভদ্রলোকটি একবারের জন্যেও অনুতপ্ত হননি।’
কাঠগড়ার দিকে ফিরে, আমার দিকে আঙুল তুলে তিনি একই উদ্যমে বলে যেতে লাগলেন। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেন তিনি একই ব্যাপারে বারবার জোর দিচ্ছেন। অবশ্য স্বীকার করছি যে তিনি ঠিকই বলেছেন; যা করেছি তার জন্যে আমি খুব-একটা অনুতপ্ত হইনি। তবুও মনে হচ্ছিল তিনি ব্যাপারটিকে অতিরঞ্জিত করেছেন। সুযোগ পেলে বন্ধুর মতো নরমভাবে তাকে বুঝিয়ে বলতাম যে, আমার পক্ষে সারাজীবন কোনোকিছুর জন্যে কখনও অনুতাপ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানকে নিয়ে সবসময় খুব বেশি ব্যতিব্যস্ত থেকেছি বা নিকট-ভবিষ্যৎকে নিয়ে, তাই পিছনে তাকাবার সময় পাইনি। অবশ্য বাধ্য হয়ে যে-অবস্থায় পড়তে হয়েছে তাতে করে এমনভাবে কারও কাছে কিছু বলার প্রশ্নই ওঠে না। বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ বা আমার কোনো ভালো উদ্দেশ্য থাকার অধিকার নেই। এরপর কী বলা হবে তা শুনতে চেষ্টা করলাম, কারণ সরকারি উকিল বিশ্লেষণ করছিলেন, যা তাঁর ভাষায় আমার ‘আত্মা’।