পরবর্তী এবং শেষ সাক্ষী ছিল রেমন্ড। আমাকে দেখে সে একটু হাত নাড়ল এবং আমার নির্দোষিতা সম্পর্কে নিশ্চিত মত দিল। বিচারক তাকে তিরস্কার করলেন। ‘তুমি এখানে সাক্ষ্য দিতে এসেছ, মামলা সম্পর্কে তোমার মতামত জানাতে নয়। তোমাকে যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হবে শুধু সেগুলির উত্তরই তুমি দেবে।’
এরপর নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল সে-সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে বলা হলে রেমন্ড পুরোপুরিভাবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। সে বলল, আমি নই, বরং রেমন্ডের বিরুদ্ধে নিহত ব্যক্তির ক্ষোভ ছিল কারণ সে তার বোনকে মেরেছিল। বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, নিহত ব্যক্তির আমাকে অপছন্দ করার। পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে কি না। রেমন্ড বলল, সেদিন ভোরে সমুদ্রসৈকতে আমার উপস্থিতি একটি আকস্মিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়।
‘তা হলে এটা কীভাবে সম্ভব যে, যে-চিঠিটা এই দুঃখজনক ঘটনার কারণ সেটা বন্দিরই হাতে লেখা?’ উত্তরে রেমন্ড জানাল এটাও একটি আকস্মিক ব্যাপার মাত্র।
সরকারি উকিল উত্তরে বললেন, এই মামলায় ‘দুর্ঘটনা’ এবং ‘আকস্মিক ব্যাপার’-এর একটা বিরাট ভূমিকা আছে বলে মনে হচ্ছে। এটাও কি একটা দুর্ঘটনা যার জন্যে রেমন্ড যখন তার রক্ষিতাকে পেটাচ্ছিল তখন আমি হস্তক্ষেপ করিনি? সুবিধাজনক এই ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটি কি পুলিশস্টেশনে রেমন্ডের জন্যে আমার প্রতীক্ষা এবং তার পক্ষে সুবিধাজনক জবানবন্দি দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল? সবশেষে তিনি, রেমন্ডকে তার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন।
নিজেকে যখন সে গুদামের দারোয়ান হিসেবে পরিচয় দিল, তখন সরকারি উকিল জুরিদের জানালেন যে, এটা সবাই জানে যে সাক্ষী মেয়েদের অসৎ উপার্জনে জীবিকা নির্বাহ করে। আমি, তিনি বললেন, লোকটির ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এবং সহকারী ছিলাম; সত্যি বলতে কি, অপরাধের পটভূমিকা নোংরা ঘটনায় ভরপুর। এবং বন্দির ব্যক্তিত্ব নৈতিকজ্ঞানবিহীন, যা একমাত্র হৃদয়শূন্য দানবেরই থাকে, ঘটনাটিকে আরও ঘৃণিত করে তুলেছে।
রেমন্ড অনুযোগ তুলতে গেল এবং আমার উকিলও প্রতিবাদ জানালেন। তাদের বলা হল, সরকারি উকিলকে তাঁর বক্তব্য শেষ করতে দেয়া উচিত।
‘আমার প্রায় হয়ে গেছে’, তিনি বললেন, তারপর রেমন্ডের দিকে ফিরে বললেন, ‘বন্দি কি তোমার বন্ধু ছিল?’
‘নিশ্চয়ই। সবার মতে বন্ধুদের মধ্যে আমরা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলাম।‘
সরকারি উকিল তখন আমাকেও একই প্রশ্ন করলেন। আমি রেমন্ডের দিকে কঠোরভাবে তাকালাম, সে তাতে বিচলিত হল না।
তারপর আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ।’ সরকারি উকিল জুরিদের দিকে তাকালেন।
‘আপনাদের সামনে দাঁড়ানো লোকটি তার মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরদিন শুধু রাত্রিকালীন উৎসবে মত্ত হয়নি, নিচুতলার বেশ্যা এবং দালালদের মধ্যেকার নোংরা বিরোধে প্ররোচিত হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে খুন করেছে। জুরিমহোদয়গণ, বন্দি এ-স্বভাবেরই লোক।’
সরকারি উকিল বসতে-না-বসতেই আমার উকিল, ধৈর্য হারিয়ে, হাত এত ওপরে ওঠালেন যে তাঁর আস্তিন সরে গিয়ে জামার ইস্ত্রি-করা হাতটার পুরোটাই দেখা গেল।
‘আমার মক্কেল কি তার মায়ের কবর দেবার জন্যে এখানে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন, না একজনকে খুন করার দায়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আদালতে চাপা-হাসির একটা ঢেউ বয়ে গেল। কিন্তু তখনই সরকারি উকিল লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং পোশাক ঠিক করতে করতে বললেন, মামলার এই দুটি উপাদানের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান সেটা তাঁর বন্ধু বুঝতে পারছেন না দেখে তিনি বিস্মিত হচ্ছেন। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে তারা পাশাপাশি অবস্থান করছে যদি এদের সেইভাবে দেখা হয়। সংক্ষেপে, প্রবল আবেগের সঙ্গে তিনি শেষ করলেন, আসামিকে আমি এই বলে অভিযুক্ত করছি যে, তার মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সে যে-ব্যবহার করেছে তাতে প্রমাণিত হয় যে অনেক আগে থেকেই মনের দিক থেকে সে অপরাধী।
এই কথাগুলো জুরি এবং দর্শকদের নাড়া দিল বেশ গভীরভাবে। আমার উকিল শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। বোঝা যাচ্ছিল, তিনিও বেশ বেকায়দায় পড়েছেন এবং আমার মনে হল পুরো ব্যাপারটা ঠিক আমার অনুকুলে যাচ্ছে না।
এর পরপরই আদালতের অধিবেশন শেষ হল। আদালত থেকে যখন বন্দিদের গাড়িতে আমাকে তোলা হচ্ছিল তখন গ্রীষ্মের সন্ধ্যার পরিচিত একটা হালকা স্পর্শে সচেতন হয়ে উঠলাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন চলন্ত সেলে বসে থাকার সময় শহরের বৈশিষ্ট্যধারক শব্দ যা আমি ভালোবাসতাম এবং দিনের বিশেষ এক সময় যা আমি সবসময় পছন্দ করতাম তা আমার ক্লান্ত মগজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নিস্তেজ বাতাসে বাচ্চা হকারদের চিৎকার, সরকারি বাগানে পাখিদের শেষ কাকলি, স্যান্ডউইচ বিক্রেতার চিৎকার, নতুন শহরের উন্নত অংশে ট্রামের শব্দ, বন্দরে যখন সন্ধ্যা আসন্ন তখন মাথার ওপরে মৃদু গুঞ্জন–সবকিছু আমাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, সবকিছু মিলে জেলখানায় ফেরা আমার কাছে মনে হচ্ছিল একজন অন্ধের এমন। একটি রাস্তা দিয়ে পথ চলা যার প্রতিটি ইঞ্চি তার মুখস্থ।
হ্যাঁ, সন্ধ্যাবেলা–যেন কতদিন আগের কথা! জীবন সম্পর্কে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এরপর আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকত সুন্দর রাত, স্বপ্নহীন ঘুম। এখন সেই একই সময়, কিন্তু একটু ভিন্ন। আমি ফিরে যাচ্ছি সেলে এবং সেখানে আমার জন্যে এমন এক রাত অপেক্ষা করছে যা আগামীদিনের অমঙ্গল আশঙ্কায় ভরপুর। এভাবেই বুঝলাম আমি যে, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আবছায়াতে চলা পরিচিত পথগুলো জেলখানায় যেয়ে শেষ হতে পারে। যেমন। শেষ হতে পারে নিরীহ ভাবনামুক্ত ঘুমে।