সরকারি উকিল এবার জানতে চাইলেন যে, মাসিক বিল পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি তা পরিশোধ করতাম কি না। সেলেস্তে হাসল, ‘হ্যাঁ, সঙ্গে সঙ্গে শোধ করে দিত। তবে ওগুলো আমার আর তার ব্যাপার।’ তখন তাকে আমার অপরাধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হল। সেলেস্তে কাঠগড়ার রেলিঙের ওপর হাত রাখল এবং বোঝা গেল কিছু বলার জন্য সে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছে।
‘আপনারা কী ভাববেন জানি না, তবে আমার মতে এটা একটা দুর্ঘটনা বা বলা চলে ভাগ্যদোষে এরূপ ঘটেছে। আর এ-ধরনের কিছু ঘটলে স্বভাবতই মাথার ঠিক থাকে না।‘
সেলেস্তে কথা চালিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু বিচারক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ তা-ই, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।’ সেলেস্তেকে একটু বিরক্ত দেখাচ্ছিল। সে বলল, সে যা বলতে চেয়েছিল তা শেষ হয়নি। তারা তাকে সংক্ষিপ্তভাবে কথা শেষ করতে বললেন।
ঘুরেফিরে তার বক্তব্য আগের মতোই হল–যে এটা একটা দুর্ঘটনা।
‘হতে পারে’, বিচারক মন্তব্য করলেন। ‘কিন্তু এখানে আমরা আইন অনুযায়ী এইসব দুর্ঘটনার বিচার করতে এসেছি। আপনি এখন যেতে পারেন।‘
সেলেস্তে ঘুরে আমার দিকে তাকাল। চোখদুটো তার টলটল করছে, ঠোঁট কাঁপছে। দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন বলতে চাচ্ছে, বন্ধু তোমার জন্যে আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি কিন্তু মনে হয় না তাতে তেমন কিছু হবে। আমি দুঃখিত।
আমি কিছু বললাম না, নড়াচড়াও করলাম না। কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার একজন পুরুষকে আমার চুম্বন করতে ইচ্ছে করছিল।
কাঠগড়া ত্যাগ করার জন্যে বিচারক তাকে আবার নির্দেশ দিলে সেলেস্তে ভিড়ের মধ্যে তার নিজের জায়গায় ফিরে গেল। বিচার চলাকালীন বাকি সময়টুকু সেখানেই হাঁটুর ওপর কনুই রেখে হাতের মধ্যে পানামা টুপিটা ধরে, সামনের দিকে ঝুঁকে শুনানির প্রতিটি কথা শুনছিল।
এরপর মারির পালা। মাথায় তার টুপি। খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে। অবশ্য খোলা-চুলেই তাকে আমার বেশি ভালো লাগে। যেখানে ছিলাম সেখান থেকেই তার বুকের কোমল রেখা, নিচের ঠোঁটের ফোলা ভাবটুকু দেখছিলাম। এ-ভাবটুকু সবসময় আমাকে মুগ্ধ করত। তাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল।
প্রথম প্রশ্ন ছিল, কদ্দিন ধরে সে আমায় চেনে। উত্তরে সে জানাল, যেদিন থেকে সে আমাদের অফিসে ঢুকেছিল সেদিন থেকেই। তখন বিচারক জানতে চাইলেন, আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা কী ধরনের। মারি জানাল, সে আমার বান্ধবী। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে মারি স্বীকার করল যে, সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। সরকারি উকিল তার সামনে-রাখা একটি নথি পড়তে পড়তে খুব তীক্ষ্ণগলায় জানতে চাইলেন, আমাদের প্রেম কবে থেকে শুরু হয়েছিল। মারি সময়টা জানাল। একটু সবজান্তা ভাব করে তিনি জানালেন, তার মানে সময়টা মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরেই। তারপর একটু ব্যঙ্গোক্তি করে বললেন, বিষয়টা খুবই অস্বস্তিকর এবং এ-সম্পর্কে তরুণী ভদ্রমহিলার মনোভাবও তার অজানা নয় কিন্তু, তার গলার স্বর কঠিন হয়ে উঠল–তার কর্তব্য তাঁকে বাধ্য করেছে। এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গের ওপর প্রশ্ন করতে।
এই মন্তব্য করার পর, তিনি, মারি যেদিন প্রথম আমার সঙ্গে শুয়েছিল সেদিনের পুরো বিবরণ দিতে বললেন। প্রথমে মারি উত্তর দিতে চাচ্ছিল না। কিন্তু সরকারি উকিল পীড়াপীড়ি শুরু করলে সে জানাল, স্নান করতে যাবার সময় আমরা দেখা করেছিলাম, তারপর সিনেমা দেখে আমার ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়েছিলাম। তিনি তখন আদালতকে জানালেন যে মারির দেওয়া বিবরণের ভিত্তিতে তিনি আমাদের সিনেমায় যাবার ব্যাপারটা মনোযোগসহকারে বিবেচনা করেছেন। তারপর মারির দিকে ফিরে যে-সিনেমাটা আমরা দেখেছিলাম তার নাম জানতে চাইলেন। খুব নিচুগলায় সে জানাল যে এই ছবিতে ফার্নান্ডেল ছিল। যখন মারি তার কথা শেষ করল তখন আদালতে পিনপতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
সরকারি উকিল খুব গম্ভীরভাবে একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখিয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলেন যে শপথ করে বলতে পারি তিনি বিচলিত হয়ে গিয়েছিলেন।
‘জুরি দ্রমহোদয়গণ, আমি আপনাদের লক্ষ করতে বলব যে, এই লোক তার মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরদিন সুইমিং পুলে গিয়েছিল, প্রেমে মত্ত হয়েছিল একটি মেয়ের সঙ্গে এবং তারপর দেখেছিল হাসির ছবি। আমি শুধু এইটুকুই বলব।’
তিনি যখন বসে পড়লেন তখনও সেখানে আগের মতোই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। এবং ঠিক তখন হঠাৎ করে মারি কান্নায় ভেঙে পড়ল। তিনি সবকিছুই অন্যভাবে নিয়েছেন, বলল মারি, সে যা বলতে চেয়েছিল তার উলটোটাই তাকে দিয়ে বলিয়ে নেয়া হয়েছে, আমাকে সে খুব ভালোভাবে চেনে এবং আমি যে অন্যায় কিছু করিনি সে-সম্পর্কে সে নিশ্চিত। প্রধান বিচারকের নির্দেশে আদালতের কর্মচারীদের একজন মারিকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন এবং শুনানি চলতে লাগল।
এর পরের সাক্ষী ম্যাসনের কথা মন দিয়ে প্রায় কেউই শুনল না। ম্যাসন জানাল, একজন যুবক হিসেবে আমি শ্রদ্ধার পাত্র এবং ‘তার চেয়েও বড় কথা হল আমি খুব ভালো ছেলে।‘ সালামানো যখন জানাল যে আমি তার কুকুরের প্রতি খুব দয়ালু ছিলাম বা আমার মা এবং আমার মধ্যে তেমন মিল ছিল না, তখনও কেউ তার প্রতি তেমন গুরুত্ব দিল না। আমি আমার মাকে কেন আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম তাও সে ব্যাখ্যা করল। ‘আপনাদের বোঝা উচিত’, সে আবার বলল, ‘আপনাদের বোঝা উচিত।‘ কিন্তু কেউ বুঝল বলে মনে হল না। তারপর তাকে নেমে যেতে বলা হল।