এরপর সরকারি উকিলকে যখন জিজ্ঞেস করা হল তিনি কোনো প্রশ্ন করবেন কি না তখন তিনি উচ্চকণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘বিন্দুমাত্র না; আমার যা দরকার তা পেয়ে গেছি।‘ তার গলার স্বর, মুখের উল্লসিত ভাব আমাকে সহসা বিমর্ষ করে তুলল। বোকার মতো আমার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছিল। এই প্রথমবারের মতো বুঝলাম সবাই আমাকে কী ঘৃণার চোখে দেখছে।
জুরিদের এবং আমার উকিলের কোনো প্রশ্ন আছে কি না জিজ্ঞেস করার পর বিচারক দারোয়ানের সাক্ষ্য নিলেন। কাঠগড়ায় উঠে লোকটি আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। প্রশ্নোত্তরের সময় সে জানাল, আমি মাকে তো দেখতে চাইইনি, বরং সিগারেট খেয়েছি, কাফে অ ল্যা খেয়েছি এবং ঘুমিয়েছি। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল আদালতের ভিতর আমার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে এবং সেই প্রথমবারের মতো মনে হল আমি অপরাধী। সিগারেট খাওয়া এবং আমার ঘুমানো সম্পর্কে সে যা বলেছিল তাকে দিয়ে তা আবার বলিয়ে নেওয়া হল। সরকারি উকিল সেই আগের মতো উল্লসিত ভাব নিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আমার উকিল দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন সে নিজেও কি তখন ধূমপান করেনি? কিন্তু সরকারি উকিল এর বিরুদ্ধে প্রবলভাবে আপত্তি জানালেন। আমি জানতে চাই এখানে কার বিচার হচ্ছে? চিৎকার করে বললেন তিনি, অথবা আমার বন্ধু কি মনে করেন যে সাক্ষীর নিন্দা করে তিনি নিজের মক্কেলের বিরুদ্ধে দেওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণাদি ভূল বলে প্রতিপন্ন করবেন? বিচারক অবশ্য দারোয়ানকে প্রশ্নের উত্তর দিতে বললেন।
লোকটি একটু ইতস্তত করল, জানি এটি করা আমার উচিত হয়নি, তারপর থেমে বলল সে, কিন্তু ঐ তরুণ ভদ্রলোক যখন আমায় একটি সিগারেট নিতে অনুরোধ করলেন তখন নেহাত ভদ্রতার খাতিরেই সিগারেটটি নিয়েছিলাম।
এ-ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য আছে কি না, জিজ্ঞেস করলেন বিচারক। ‘না’, বললাম আমি, সাক্ষী ঠিকই বলেছে। কথাটা সত্যি যে তাকে আমি সিগারেট নিতে অনুরোধ করেছিলাম।
দারোয়ান অবাক হয়ে এবং খানিকটা কৃতজ্ঞ-দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে জানাল যে সে-ই আমাকে কফি খেতে বলেছিল।
আমার উকিল উল্লসিত হয়ে বললেন, ‘জুরিরা নিশ্চয় এ-স্বীকারোক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন।‘
সরকারি উকিল অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। ‘নিশ্চয়ই’, আমাদের মাথার ওপর তাঁর গর্জন শোনা গেল, ‘জুরিরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন। এবং তারা এই উপসংহারে পৌঁছবেন যে, বন্দির উচিত ছিল, যে-অসহায় মহিলা তাকে এই পৃথিবীতে এনেছিলেন তাঁর মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে তৃতীয় ব্যক্তির কফি খাওয়াবার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা।‘
এরপর দারোয়ান তার নিজের জায়গায় ফিরে গেল। থমাস পিরেজকে এরপর ডাকা হল এবং কাঠগড়ায় ওঠার সময় তাকে সাহায্য করতে হল। পিরেজ জানালেন যদিও আমার মা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, কিন্তু আমার সঙ্গে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিনই মাত্র দেখা হয়েছিল। ঐদিন আমার চালচলন কেমন ছিল সে-সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানালেন : ‘দেখুন, আমার মেজাজ খুব ভালো ছিল না। মেজাজটা এতই খারাপ ছিল যে অন্যকিছু খেয়াল করার মতো অবস্থা আমার ছিল না। মনে হয় দুঃখ আমাকে ঢেকে দিয়েছিল। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মৃত্যু আমাকে খুব কাতর করে তুলেছিল। সত্যি বলতে কি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। সুতরাং তরুণ ভদ্রলোকটিকে আমি মোটেই খেয়াল করিনি।’
আমাকে তিনি কাঁদতে দেখেছেন কি না তা আদালতকে জানাবার জন্যে সরকারি উকিল তাকে বললেন। পিরেজ যখন বললেন ‘না’ তখন তিনি জোর দিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয় জুরিরা এই উত্তর লক্ষ করবেন।’
আমার উকিল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, মনে হল, অনাবশ্যক আক্রমণাত্মক গলায় পিরেজকে জিজ্ঞেস করলেন :
ভালো করে ভেবে দেখুন। আপনি কি নিশ্চিত যে তাকে আপনি কাঁদতে দেখেননি।
পিরেজ বললেন, ‘না।’
উত্তর শুনে কিছু লোক মুখ টিপে হাসল এবং আমার উকিল তার গাউনের একটি আস্তিন গুটিয়ে কঠোরভাবে বললেন : ‘অদ্ভুতভাবে এই মামলা পরিচালিত হচ্ছে। আসল ঘটনা উদঘাটন করার কোনো চেষ্টাই হচ্ছে না!’
সরকারি উকিল এই মন্তব্যে কান দিলেন না, স্থিরভাবে ফাইলের মলাটের ওপর পেনসিল ঠুকতে লাগলেন।
পাঁচ মিনিটের বিরতি ঘোষণা করা হল, আর তখন আমার উকিল আমাকে জানালেন যে, সবকিছু খুব ভালোভাবে চলছে। এরপর সেলেস্তেকে ডাকা হল। তাকে আসামিপক্ষের সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করা হল। আসামি বলতে বোঝানো হল আমাকে।
সেলেস্তে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। সাক্ষ্য দেবার সময় সে হাতের মুঠোয় বারবার মোচড়াচ্ছিল পানামা টুপিটাকে। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে রবিবার রেসের মাঠে যাবার সময় তার সবচেয়ে সুন্দর যে-সুটটা পরত সেটাই সে এখানে পরে এসেছে। কিন্তু যে-কারণেই হোক সে তার কলার পরেনি। দেখলাম তার শার্টের ওপরটা একটা পিতলের বোতাম দিয়ে আটকানো। আমি তার খরিদ্দার ছিলাম কি না একথা জিজ্ঞেস করা হলে সে বলল, ‘হ্যাঁ, এবং একজন বন্ধুও ছিল বটে।’ তাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলতে বলা হলে সে বলল, আমি স্বাভাবিক লোক ছিলাম। তাকে এই কথা ব্যাখ্যা করতে বলা হলে সে জানাল যে, সবাই জানেন এই কথার মানে কী। ‘আমি কি চাপা-স্বভাবের লোক ছিলাম?’ ‘না’–উত্তরে সেলেস্তে বলল, ‘ঐরকম কোনো মন্তব্য আমি তার সম্পর্কে করব না। তবে অন্যান্য অনেকের মতো সে বাজে-কথা বলত না।’