‘দ্যাখো, আমি ঠিক বলতে পারছি না।’ উত্তর দিলাম আমি।
সে তার শাদা গোঁফজোড়া কিছুক্ষণ পাকাল। তারপর শান্তভাবে বলল: ‘আমি বুঝেছি।’
দারোয়ানটি দেখতে মন্দ নয়, চোখ তার নীল আর গালদুটো রক্তিম। আমাকে কফিনের পাশে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে নিজে ঠিক তার পিছে বসল। নার্স উঠে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। যখন সে যাচ্ছিল তখন দারোয়ানটি আমার কানে কানে বলল:
‘আহ বেচারির টিউমার হয়েছে।‘ আমি আরেকটু খুঁটিয়ে দেখলাম নার্সটিকে। তার চোখের নিচ দিয়ে মাথার চারপাশে ব্যান্ডেজ বাধা। কেউ তার মুখের দিকে তাকালে শাদাই দেখবে।
নার্স চলে যেতেই দারোয়ান উঠে দাঁড়াল। ‘এখন আপনাকে একলা ছেড়ে যাচ্ছি।’
জানি না আমি কোনো ইশারা করেছিলাম কি না কিন্তু দারোয়ান চলে যাওয়ার বদলে থামল। আমার পিছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে এ-অনুভূতিটা মনে জাগতেই অস্বস্তি লাগল। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। পুরো ঘরে অস্তগামী সূর্যের নরম আলো। মাথার ওপর স্কাইলাইটের কাছে গুঞ্জন করছিল দুটি ভ্রমর। খুব ঘুম পাচ্ছিল আমার, চোখ খোলা রাখতে পারছিলাম না। পেছন না-ফিরেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম ক’বছর এই আশ্রমে সে চাকরি করছে। ‘পাঁচ বছর।‘ এবং উত্তরটা এমনভাবে এল যে শুনে মনে হল, সে বুঝি কোনো প্রশ্নের অপেক্ষায়ই ছিল।
তারপর সে মুখ খুলল। দশ বছর আগে যদি কেউ তাকে বলত যে, মারেনগোর এই আশ্রমে সে একজন সাধারণ দারোয়ান হয়ে দিন কাটাবে, তা, হলে তখন হয়তো সে তা বিশ্বাস করত না। বয়স তার চৌষট্টি, বলল সে, আর জন্ম প্যারিসে।
সে একথা বলার পর কিছু না-ভেবেই মাঝখানে বলে বসলাম, ‘ওহ্, তা হলে। তুমি এখানকার লোক নও।’
আমার হঠাৎ করে তখন মনে হল, ওয়ার্ডেনের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় মা’র সম্পর্কে আমাকে সে কিছু বলেছিল। বলেছিল, মাকে একটু তাড়াতাড়ি কবর দিতে, কারণ এ-জায়গায় গরমটা একটু বেশি। ‘প্যারিসে মৃতদেহ তারা তিনদিন পর্যন্ত রেখে দেয়, কোনো কোনো সময় চারদিন।‘ তারপর সে জানাল, জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে তার প্যারিসে, তাই প্যারিসকে সহজে সে ভুলতে পারে না। ‘এখানে সবকিছু তাড়াতাড়ি হয়। কেউ মারা গেলে সে যে মরেছে একথাটা ভাববার অবকাশ না দিয়েই মৃতদেহের সকার হয়ে যায়।‘ ‘অনেক হয়েছে।’ বলল ওর বউ, ‘এসব বাজে কথা এ-ভদ্রলোককে বলা কি তোমার উচিত হচ্ছে?’ সে তখন লজ্জা পেয়ে বারবার আমার কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল। বললাম, ‘এমন কিছুই হয়নি যার জন্যে ক্ষমা চাইতে হবে।‘ আসল কথা, তার কথাবার্তা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। কারণ, এসব কথা আগে কখনও আমার মনে হয়নি।
তারপর সে বলল, প্রথমে এই আশ্রমে ঢুকেছিল সে সাধারণ একজন আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু শরীর মন সজীব ছিল তখনও, তাই দারোয়ানের চাকরিটা খালি হলে সে নিজেই তাতে বহাল হতে চেয়েছিল।
বললাম, তা হলেও, অন্যদের মতো সে-ও একজন আশ্রমবাসী। কিন্তু তাতে সে কোনো উত্তর দিল না। সে ‘একজন কর্মচারীর মতো।‘ আগেই খেয়াল করেছিলাম, তার বয়সী বৃদ্ধদের সে ‘তারা’ বা ‘সেইসব বুড়ো’ বলে সম্বোধন করছিল। তবুও তার মনোভাব অনুভব করতে পারছিলাম। দারোয়ান হিসেবে ছিল তার খানিকটা দাপট আর খানিকটা কর্তৃত্ব।
ঠিক সে-সময় নার্স ফিরে এল। সন্ধ্যা নেমে এল যেন খুব তাড়াতাড়ি। স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে আকাশটাকে মনে হচ্ছিল কালো। দারোয়ান বাতি জ্বেলে দিল। বাতির প্রথম আলোয় চোখে ধাঁধা দেখলাম।
সে তখন প্রস্তাব করল খাবার-ঘরে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিতে। কিন্তু আমার খুব-একটা খিদে ছিল না। তখন সে প্রস্তাব করল, আমাকে সে এক কাপ কাফে অ ল্যা খাওয়াতে পারে। পানীয়টি আমার প্রিয়, তাই বললাম, ‘ধন্যবাদ’। কয়েক মিনিট পর সে ফিরে এল ট্রে-হাতে। কফি খাবার পর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মা’র সামনে–এই অবস্থায় সিগারেট খাওয়া ঠিক হবে কি না। বুঝতে পারছিলাম না। খানিকটা ভেবে দেখলাম, না, এতে কিছুই যায় আসে না। তাই দারোয়ানকে একটা সিগারেট দিলাম, তারপর দুজনে তা টানতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার সে কথা বলা শুরু করল :
‘জানেন, আপনার মা’র বন্ধুরা এখুনি আসবে আপনার সঙ্গে মৃতদেহের পাশে বসে রাত জাগতে। আমাদের এখানে কেউ মারা গেলে আমরা তার মৃতদেহের পাশে বসে রাত জাগি। যাই দেখি, কিছু চেয়ার আর একপট কালো কফি জোগাড় করা যায় কি না।’
শাদা দেয়ালে বাতির উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হওয়ায় চোখে লাগছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, একটা বাতি সে নিভিয়ে দিতে পারে কি না। ‘কিছুই করার নেই’, বলল সে, ‘তারা এমনভাবে বাতিগুলোর বন্দোবস্ত করেছে যে হয় সবকটিই জ্বলবে না-হয় একটিও জ্বলবে না।’ একথার পর আর তার দিকে নজর দিলাম না। সে বাইরে থেকে কিছু চেয়ার এনে কফিনের চারপাশে সাজিয়ে রাখল। একটিতে রাখল একপট কফি আর দশ-বারোটি পেয়ালা। সব গুছিয়ে রেখে, মা’র অন্যদিকে, আমার মুখোমুখি সে বসল। নার্সটি ঘরের অন্যপাশে, আমার দিকে ছিল তার পিঠ। সে কী করছিল তা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না।
কিন্তু তার হাত নড়া দেখে মনে হল সে কিছু-একটা বুনছে। খুব আরাম লাগছিল আমার, কফি তুলেছিল আরো চাঙা করে। খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসছিল। ফুলের সুবাস, স্পর্শ পাচ্ছিলাম রাতের ঠাণ্ডা বাতাসের। মনে হয়, কিছুক্ষণ ঝিমিয়েছিলামও।