আর ঠিক তখনই আমার শুনানি শুরু হল। বিচারক শান্ত, সরলভাবে আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন; একসময় মনে হল এর মধ্যে কিছুটা সহৃদয়তা লুকানো আছে। প্রথমবারের মতো পরিচয় জানবার জন্যে আমাকে প্রশ্ন করা হল। মনে-মনে বিরক্ত হলেও বুঝলাম, এটাই স্বাভাবিক। আর যা-ই হোক, আদালত। যদি শেষে আবিষ্কার করে তারা একজন ভুল লোকের বিচার করছে তা হলে ব্যাপারটা খুব আনন্দদায়ক হবে না।
বিচারক তারপর আমি কী কী করেছি তার একটা ফিরিস্তি শুরু করলেন, দু-তিনটি বাক্য শেষ হওয়া মাত্রই তিনি জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ঠিক তো? প্রত্যুত্তরে আমি প্রত্যেকবার আমার উকিলের পরামর্শ অনুযায়ী বললাম, ‘জি, স্যার। প্রচুর সময় লাগল এতে, কারণ বিচারক প্রত্যেকটি ছোটখাটো ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। অন্যদিকে সাংবাদিকরা ব্যস্তভাবে কলম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝে সচেতন হয়ে অনুভব করছিলাম সেই তরুণ সাংবাদিকের চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ। সেই ছোটখাটো রোবট মহিলাও তাকিয়ে ছিলেন ঐভাবে। জুরির সবাই তাকিয়ে ছিলেন লাল-পোশাকপরা বিচারকের দিকে এবং তখন আবার আমার ট্রামের একপাশে বসে থাকা আরোহীদের কথা মনে পড়ল। মৃদুভাবে একটু কেশে। তিনি ফাইলের কিছু পাতা ওলটালেন এবং আমাকে সম্বোধন করলেন।
তিনি এখন এমন কিছু ব্যাপারে আলোচনা করতে চান, বললেন তিনি, যা মামলার ব্যাপারে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হতে পারে কিন্তু আসলে তা মামলার সঙ্গে যুক্ত। আমার মনে হল তিনি মা’র সম্পর্কে আলোচনা করবেন যা আমার কাছে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। তাঁর প্রথম পশ্ন ছিল, কেন আমি মাকে আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম? উত্তরে আমি জানালাম, কারণটা খুবই সরল; বাড়িতে মাকে রেখে ভালোভাবে দেখাশোনা করার মতো যথেষ্ট টাকা আমার ছিল না। তখন তিনি জানতে চাইলেন আমাদের বিচ্ছেদ আমার জন্যে দুঃখজনক ছিল কি না। বললাম : মা এবং আমি পরস্পরের কাছ থেকে বেশিকিছু আশা করিনি, অন্য কারও থেকে তো নয়ই! দুজনেই নতুন ব্যবস্থায় সহজেই মানিয়ে নিয়েছিলাম। বিচারক তখন বললেন, এ-ব্যাপারে খুব বেশি জোর দেয়ার ইচ্ছে তাঁর নেই; সরকারি উকিলকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই ব্যাপারে তার কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
আমার দিকে আধাআধিভাবে পিছন ফিরে সরকারি উকিল বসে ছিলেন। আমার দিকে না-ফিরেই তিনি বললেন, মাননীয় বিচারকের অনুমতি নিয়ে তিনি জানতে চান আরবদের হত্যা করার জন্যে আমি ঝরনার ধারে গিয়েছিলাম কি না। বললাম, না। তাহলে কেন আমি রিভলভার নিয়ে ঠিক সেই জায়গায় ফিরে গিয়েছিলাম? বললাম, ব্যাপারটা ছিল আকস্মিক। সরকারি উকিল তখন অত্যন্ত নোংরাভাবে বললেন, ভালো ভালো। ব্যস, এখন এ-পর্যন্ত হলেই চলবে।
এরপর কী হল বুঝতে পারলাম না। যাহোক, সরকারি উকিল, বিচারক এবং আমার উকিলের মধ্যে কিছু বাদানুবাদের পর প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করলেন, দুপুর পর্যন্ত আদালত মুলতবি থাকবে। তারপর আবার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
কী ঘটছে তা বোঝার আগেই আমাকে প্রিজনভ্যানে ওঠানো হল। ফিরে এলে আমাকে দুপুরের খাবার দেয়া হল। খানিক পর, ক্লান্তি অনুভব করার আগেই তারা এল আমাকে নিতে। আবার সেই আগের ঘরে ফিরে এলাম, আবার মুখোমুখি হলাম পুরনো মুখগুলির, আবার আগের মতো শুরু হল সবকিছু। কিন্তু এরই মধ্যে গরম বেড়ে গিয়েছিল এবং আমার উকিল, সরকারি উকিল এবং কিছু সাংবাদিকের জন্য পাখার ব্যবস্থা করা হল। সেই যুবকটি এবং রোবট মহিলাটি তখনও তাদের জায়গায় বসে ছিল। কিন্তু পাখা দিয়ে নিজেদের বাতাস না করে আগের মতোই তারা আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
মুখের ঘাম মুছে ফেললাম, কিন্তু আশ্রমের ওয়ার্ডেনকে সাক্ষী দিতে ডাকার আগ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, আমার বিরুদ্ধে মা’র কোনো অভিযোগ ছিল কি না। বললেন তিনি, ‘হ্যাঁ। কিন্তু সেটা তেমন কিছু না; আশ্রমের প্রায় সব বাসিন্দারই তাদের আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে কিছু-না-কিছু অভিযোগ ছিল। বিচারক আরও স্পষ্টভাবে তাকে তার বক্তব্য পেশ করতে বললেন; মাকে আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, সেজন্যে কি আমার বিরুদ্ধে মা’র অভিযোগ ছিল? তিনি ফের একই উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।’ কিন্তু এবার তিনি আর তার উত্তরের ব্যাখ্যা করলেন না।
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন যে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন আমার স্থৈর্য। দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হল স্থৈর্য বলতে তিনি কী বোঝাচ্ছেন তখন তিনি চোখ নিচু করে নিজের জুতোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এরপর তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, আমি মার মৃতদেহ দেখতে চাইনি, অথবা মার জন্যে একফোঁটা চোখের জলও ফেলিনি এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবার পর তার কবরের কাছে একটুও না-থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছি। আরেকটি জিনিস তাকে অবাক করেছিল। মুদাফরাশদের একজন তাকে বলেছিল যে আমি আমার মার বয়েস জানতাম না। খানিকক্ষণ নীরবতা; তারপর বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি ধরে নেবেন যে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামি সম্পর্কেই এসব বলছেন? ওয়ার্ডেন এতে হকচকিয়ে গেলে বিচারক বললেন, ‘প্রশ্নটা আনুষ্ঠানিক আমাকে করতেই হবে।‘