‘তুমি দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর আমরা বিয়ে করব।’
আমি শুধু তার শাদা দাঁতের উজ্জ্বলতা এবং চোখের চারপাশের অল্প ভাজই দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হল আমার কিছু-একটা উত্তর দেয়া প্রয়োজন তাই উত্তর দিলাম : তুমি কি সত্যিই তা-ই বিশ্বাস করো?
সে সেই একই রকম উঁচুগলায় খুব তাড়াতাড়ি বলতে লাগল :
‘হ্যাঁ, তুমি ছাড়া পাবে আর আমরা আবার রোববারে একসঙ্গে সাঁতার কাটতে যাব।’
মারির পাশের মহিলাটি তখনও চাচাচ্ছিল, বলছিল যে তার স্বামীর জন্যে জেলঅফিসে একটি ঝুড়ি এবং জিনিসের ফর্দ রেখে যাবে, সে যেন ঠিকঠাক মতো সব মিলিয়ে নেয়, কারণ এগুলি কিনতে তার বেশকিছু খরচ করতে হয়েছে। অন্য পাশের যুবকটি এবং তার মা তখনও একজন আরেকজনের দিকে বিষণ্ণভাবে তাকিয়েছিল এবং আরবদের মৃদুস্বর আমাদের নিচে গুঞ্জন তুলছিল। বাইরে আলো যেন আছড়ে পড়ছিল জানলায়, ঢুকে পড়ছিল ভেতরে, এবং মুখোমুখি সবার মুখ আবৃত করে দিচ্ছিল যেন এক পরত হলুদ তেলে।
আমার একটু বমি-বমি লাগছিল, ইচ্ছে করছিল এখান থেকে চলে যাই। পাশের কর্কশ স্বর কানে বাড়ি মারছিল। কিন্তু অন্যদিকে যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ মারির সান্নিধ্যে থাকতে ইচ্ছে করছিল। কতক্ষণ কেটে গেল খেয়াল ছিল না। একই হাসি মুখে রেখে মারি তার কাজের বিবরণ দিচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্যেও কিন্তু চাচামেচি, পরস্পরের সঙ্গে কথা এবং সেই কর্কশধ্বনি বন্ধ হয়ে যায়নি। একমাত্র নীরবতার মরূদ্যান সৃষ্টি করেছিল সেই তরুণটি এবং তার বৃদ্ধা মা যারা নীরবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
তারপর একজন একজন করে আরবদের নিয়ে যাওয়া হল; প্রথমজন চলে। গেলে প্রায় সবাই নীরব হয়ে গেল। সেই ছোটখাটো বৃদ্ধা মহিলাটি জেলখানার শিকগুলি চেপে ধরলেন এবং ঠিক সেই মুহূর্তে একজন পাহারাদার তার ছেলের কাঁধে টোকা দিল। সে বলল, ‘বিদায় মা’, আর সেই মহিলা শিকের ভিতর হাত গলিয়ে আস্তে একটু হাত নাড়লেন।
তিনি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টুপি-হাতে একজন তার জায়গা নিল। একজন বন্দিকে আমার পাশের খালি জায়গায় নিয়ে আসা হলে দুজনে আস্তে আস্তে কথা শুরু করল, কারণ ঘরটা তখন আগের চেয়ে অনেক শান্ত। অন্য একজন এসে আমার ডানদিকের লোকটিকে সরিয়ে নিল। তার স্ত্রী চিৎকার করে বলল, যদিও চিৎকার করার কোনো দরকার ছিল না—’শোনো, নিজের প্রতি খেয়াল রেখো লক্ষ্মীটি–তাড়াহুড়ো করে কিছু কোরো না!’
এরপর আমার পালা। মারি আমার উদ্দেশে চুমু ছুঁড়ে দিল। চলে আসার সময় পিছন ফিরে তাকালাম। সে তখনও চলে যায়নি, মুখ তার তখনও গরাদে সাঁটা, সেই হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁটদুটো তখনও আবেগে ফাঁক করা।
এর কিছুদিন পর আমি মারির চিঠি পেলাম। আর তখন থেকেই যেসব ব্যাপারে আমি আলোচনা পছন্দ করতাম না তা-ই শুরু হল। ব্যাপারগুলো খুব একটা ভয়ংকর কিছু নয়, কোনোকিছু বাড়িয়ে বলার ইচ্ছেও আমার ছিল না এবং অন্যদের তুলনায় আমি কষ্ট পেতামও কম; তবুও সেই পুরানো দিনগুলিতে একটা জিনিস ছিল যা সত্যিই বিরক্তিকর, তা হল স্বাধীন মানুষের মতো চিন্তা। যেমন, হঠাৎ সমুদ্রে গিয়ে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করত। পায়ের নিচের ঢেউয়ের মৃদু শব্দ, শরীরে পানির কোমল স্পর্শ এবং এর আনন্দদায়ক অনুভূতির চিন্তা আমাকে আমার সেলের ক্ষুদ্রতা সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুলত।
অবশ্য এই পর্বটি অল্প কিছুদিন স্থায়ী হয়েছিল। এরপর বন্দির মতো চিন্তা করতাম। জেল-প্রাঙ্গণে প্রাত্যহিক ভ্রমণ এবং আমার উকিলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্যে প্রতীক্ষা করতাম। বাকি সময়টুকুও সত্যি সত্যি কাটিয়ে দিতাম। প্রায়ই মনে হত আমাকে আর কিছু করতে দেয়া ছাড়া, শুধু যদি মরাগাছের গুঁড়ির ভেতর শুইয়ে মাথার ওপরের একটুকরো আকাশ দেখতে বাধ্য করা হত তা হলেও আমি হয়তো এতে অভ্যস্ত হয়ে যেতাম। হয়তো আমি পাখিদের অথবা মেঘের আনাগোনা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যেতাম। যেভাবে আমি আমার উকিলের গলার অদ্ভুত নেকটাই নজর করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম অথবা অন্য এক জগতে, যেখানে রোববারে মারির সঙ্গে প্রেম করার জন্যে শান্তভাবে অপেক্ষা করতে হত।
অবশ্য এখানে ফাপা গাছের গুঁড়িতে আমাকে আটকে রাখা হয়নি। পৃথিবীতে আমার চাইতেও অনেক দুঃখী লোক আছে। মনে পড়ল, মায়ের একটি প্রিয় ধারণা ছিল–যা অহরহ তিনি বলতেন–যে একসময়ে-না-একসময় সবাই সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
আমি কিন্তু তেমনভাবে কোনোকিছুই ভাবিনি। প্রথমদিকে অবশ্য সময়টা ছিল যন্ত্রণাদায়ক; কিন্তু সামান্য চেষ্টায়ই আমি এ-সময়টা পেরুতে পেরেছিলাম। যেমন, যে-কোনো নারীর সান্নিধ্যের জন্যে আমি ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিলাম, অবশ্য এটা আমার বয়সের জন্যে ছিল স্বাভাবিক। মারির কথা বিশেষ করে ভাবিনি। এইসব মহিলার সঙ্গে আমি কীভাবে প্রেম করব বা তাদের পাব এইসব চিন্তা আমার মনকে আবিষ্ট করে রেখেছিল; বিভিন্ন মুখের ভিড়ে আমার সেল যেন ভরে গেল; আমার পুরানো আবেগের প্রেতাত্মা সব। এইসব চিন্তাভাবনা আমাকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলত বটে কিন্তু এতে আমার সময়টা বেশ কেটে যেত।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রধান কারাধ্যক্ষের সঙ্গে আমার বেশ খাতির হয়ে গেল। প্রতিদিন খাবারের সময় তিনি তদারক করতে আসতেন। প্রথমে তিনিই মহিলাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। ‘এখানে সবাই এ নিয়েই বেশি মাথা ঘামায়’, বললেন তিনি। আমি জানালাম যে আমার নিজের বেলাতেও একই ব্যাপার ঘটছে। ‘এটা অন্যায়’, যোগ করলাম আমি, ‘এ যেন মড়ার ওপর খাড়ার ঘা।’—’এখানেই তো মজা’, বললেন তিনি, ‘আর সেজন্যেই তো তোমাদের আটক রাখা হয়েছে।‘–’ঠিক বুঝতে পারলাম না।‘—‘স্বাধিকার’, বললেন তিনি, ‘মানে তা-ই। কিন্তু তোমাদের স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।‘ এ-জিনিসটা আগে খেয়াল করিনি। কিন্তু এখন তাঁর বক্তব্যটা ধরতে পারলাম। ‘সত্যিই তো’, বললাম আমি, ‘না হলে তো এটা শাস্তি হত না।‘ কারাধ্যক্ষ মাথা নাড়লেন, ‘তুমি একটু আলাদা, মাথা খাটাতে পারো। অন্যেরা তাও পারে না। কিন্তু তবুও তারা একটা পথ খুঁজে নেয়; নিজের চেষ্টায়ই তা করে।‘ এই বলে তিনি আমার সেল ছেড়ে চলে গেলেন। পরদিন আমিও অন্যদের পথ অনুসরণ করলাম।