.
২.
কিছু-কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে আমি কখনও কিছু বলার কথা ভাবিনি। এবং জেলে নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পর মনে হল জীবনের এই পর্যায়টুকু হচ্ছে ঐসব বিষয়ের একটি। যা হোক, সময় কাটার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এই বিতৃষ্ণার কোনো আসল সারবস্তু নেই। সত্যি বলতে কি, প্রথম কয়েকদিন আমি যে জেলে আছি। এ-সম্পর্কেই সচেতন ছিলাম না। সবসময় একটা অনিশ্চিত আশা ছিল কিছু একটা ঘটবে, আশাপ্রদ, অবাক-করা কিছু।
মারির প্রথম এবং একমাত্র সাক্ষাতের পরই পরিবর্তনটা এল। সেদিন আমি তার লেখা একটি চিঠি পেলাম, যাতে সে লিখেছিল তারা তাকে আর আমার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না যেহেতু সে আমার স্ত্রী নয়। সেদিন থেকে বুঝলাম এই সেলই হচ্ছে আমার সর্বশেষ আস্তানা, যাকে অনেকে হয়তো বলবে অন্তিমতা।
আমার গ্রেফতারের দিন তারা আমাকে আরও কিছু কয়েদির সঙ্গে, যাদের বেশির ভাগই ছিল আরব, বিরাট এক ঘরে রেখেছিল। আমাকে ঢুকতে দেখে ওরা জিজ্ঞেস করল, আমি কী করেছি। বললাম, আমি একজন আরবকে খুন করেছি। এটা শুনে ওরা কিছুক্ষণের জন্যে চুপ মেরে গেল। আস্তে রাত নেমে এলে ওদের একজন দেখিয়ে দিল কীভাবে মাদুর বিছাতে হবে। একপ্রান্ত গুটিয়ে নিয়ে বালিশের কাজও চলে যায়। সারারাত অনুভব করলাম মুখের ওপর ছারপোকারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কয়েকদিন পর আমাকে একলা এক সেলে ঢোকানো হল যেখানে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটি তক্তার বিছানায় আমি শুতাম। অন্য আসবাবের মধ্যে ছিল মলত্যাগের জন্যে একটা বালতি এবং টিনের একটি বেসিন। সেটা ছিল একটু উঁচু জমিতে, ফলে ছোট জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখতে পেতাম। একদিন শিক ধরে কূলে ঢেউয়ের ওপর রোদের খেলা দেখছি এমন সময় ওয়ার্ডার এসে বলল, আমাকে একজন দেখতে এসেছে। মনে হল নিশ্চয় মারি এবং ঠিক তা-ই।
ভিজিটার-রুমে যাওয়ার জন্যে একটি করিডোর, কিছু সিঁড়ি, তারপর আরেকটি করিডোর পার হতে হল। ঘরটি বেশ বড়সড়, একটি বড় নিচু জানালা দ্বারা আলোকিত এবং উঁচু লোহার শিক আড়াআড়িভাবে ঘরটিকে তিনভাগে ভাগ করেছে। দুটো শিকের মাঝে ব্যবধান প্রায় ত্রিশ ফুট যা বন্দি এবং তার বন্ধুদের মাঝে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হিসেবে কাজ করছে। আমাকে ঠিক মারির বিপরীতে নিয়ে যাওয়া হল, পরনে ছিল তার ডোরাকাটা পোশাক। আমার পাশে রেলিঙে ছিল আরও ডজনখানেক বন্দি। বেশির ভাগই আরব। মারির দিকে যারা ছিল তারা প্রায় সবই মুর রমণী। একজন ছোটখাটো বৃদ্ধা এবং টুপি-ছাড়া মোটাসোটা একজন মেট্রনের মাঝে মারি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মেট্রনটি সবসময় অঙ্গভঙ্গি করে তীক্ষ্ণগলায় কথা এলছিল। সাক্ষাৎপ্রার্থী এবং বন্দিদের মধ্যে দূরত্ব থাকায় দেখলাম আমাকেও গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলতে হল।
ঘরের মধ্যে ঢোকার পর, শূন্য দেয়ালে কথার বুদ্বুদের প্রতিধ্বনি, সূর্যের আলো যার তীক্ষ্ণ শাদা দ্যুতির বন্যা ভাসিয়ে দিচ্ছিল সবকিছুকে, আমাকে উদ্ভ্রান্ত করে দিল। সেলের নৈঃশব্দ এবং খানিকটা আঁধারে অভ্যস্ত থাকায় এ-অবস্থায় অভ্যস্ত হতে আমার কিছুটা সময় লাগল। কিছুক্ষণ পর, আমি সবার মুখ পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম যেন তাদের উপর স্পটলাইট ফেলা হয়েছে।
গ্রিলের মাঝে যে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ তার দুপাশে দেখলাম জেলের কর্মচারী বসে আছে। দেশী বন্দিরা ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা পরস্পরের বিপরীতে বসে আলাপ করছিল। গলার স্বর তাদের নিচু এবং হৈচৈ থাকা সত্ত্বেও তারা ফিসফিস করে আলাপ করছিল। নিচে থেকে উঠে-আসা স্বরের এই গুঞ্জন যেন সঙ্গত করছিল মাথার ওপর চলতে থাকা কথোপকথনের সঙ্গে। সবকিছুর ওপর দ্রুত নজর বুলিয়ে মারির দিকে এক পা এগিয়ে গেলাম। শিকের ওপর সে তার বাদামি, সূর্যস্নাত মুখটা চেপে ধরে যতটা সম্ভব হাসছিল। বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছিল তাকে কিন্তু কোনোরকমেই কথাটা তাকে বলতে পারলাম না।
বেশ উঁচুস্বরে সে জিজ্ঞেস করল, কী খবর? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? দরকারি সবকিছু পাচ্ছ তো?
হ্যাঁ, দরকারি সবকিছুই পাচ্ছি।’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ; মারি হাসতে লাগল। আমার পাশে দাঁড়ানো বন্দিটিকে সেই মোটাসোটা মহিলা বকছিল, লম্বা, কমনীয় ফরসা লোকটি খুব সম্ভব তার স্বামী। জা’ তাকে নিতে চাচ্ছে না, চিৎকার করে সে বলল। ব্যাপারটা তা হলে তো খুব খারাপ। লোকটি উত্তর দিল-হ্যাঁ, আমি তাকে বলেছি তুমি বের হয়ে এলেই তাকে ফেরত নিয়ে নেবে, কিন্তু সে তা কানে তুলছে না।
মারি চেঁচিয়ে বলল, রেমন্ড আমাকে তার শুভেচ্ছা জানিয়েছে এবং উত্তরে আমি বললাম ‘ধন্যবাদ’, কিন্তু আমার প্রতিবেশীর প্রশ্নে আমার স্বর ডুবে গেল। তার শরীর ভালো তো? মোটা মহিলাটি হাসলেন, ভালো? সম্পূর্ণ সুস্থ। একেবারে নাদুসনুদুস।
অন্যদিকে আমার বাঁ-পাশের বন্দি, তরুণ, শীর্ণ, হাতগুলি মেয়েদের মতো, একটি কথাও বলেনি। বিপরীত দিকের বৃদ্ধার দিকে সে তাকিয়ে ছিল এবং তিনি ক্ষুধার্ত এক আবেগের সঙ্গে সেই দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের দিকে আর তাকানো গেল না, কারণ মারি চিৎকার করে বলল, আমাদের আশা হারানো উচিত নয়।
‘নিশ্চয় নয়’। আমি উত্তর দিলাম। চোখ পড়ল তার কাঁধের দিকে, হঠাৎ ইচ্ছে হল পাতলা কাপড়ের ওপর দিয়ে ঐ কাঁধে একটু চাপ দিই। কাপড়টার সিল্কের মতো টেক্সচার আমাকে মুগ্ধ করে তুলছিল এবং মনে হল মারি যে আশার কথা বলেছে তা যে-করেই হোক যেন এখানেই কেন্দ্রীভূত। মনে হল মারিও বোধহয় একই কথা চিন্তা করছে, কারণ সে সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে হেসেই চলল।