সত্যি বলতে কী তার মন্তব্যগুলি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না। কারণ অফিসটা ছিল গরম আর শব্দ করে বড় বড় মাছি ঘুরছিল, গালের ওপর বসছিল; তা ছাড়া তিনি আমাকে খানিকটা সতর্ক করে তুলেছিলেন। অবশ্য আমি বুঝেছিলাম এ-ধরনের ভাবনা অবাস্তব, কারণ বলতে গেলে আমিই হলাম অপরাধী। যাহোক, তিনি কথা বলে যেতে লাগলেন, আমি মনোযোগ দিয়ে তা বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম এবং বুঝলাম আমার স্বীকারোক্তির একটি অংশ। আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার তা হল দ্বিতীয়বার গুলি করার আগে কেন বিরতি দিয়েছিলাম। বাকি সবকিছু বলতে গেলে ঠিকই আছে; কিন্তু এই ব্যাপারটা তাকে দিশেহারা করে দিচ্ছে।
বলতে যাচ্ছিলাম, এ-ব্যাপারে জোর দেয়া ভুল; ব্যাপারটার তেমন গুরুত্ব নেই। কিন্তু বলার আগেই তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, এবং অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কি না। যখন বললাম না তখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন।
অসম্ভব, বললেন তিনি; সবাই ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, এমনকি যারা তাকে প্রত্যাখ্যান করে তারাও। এ-ব্যাপারে তিনি একেবারে নিশ্চিত; যদি এ-বিষয়ে কোনো দ্বিধা দেখা দিত তবে জীবন তার কাছে অর্থশূন্য হয়ে উঠত। ‘তুমি কি চাও’, ক্রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘আমার জীবন অর্থশূন্য হয়ে উঠুক?’ আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমার ইচ্ছে কীভাবে এর ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এবং তা জানালামও তাকে।
আমি যখন কথা বলছিলাম, তখন তিনি আবার কুশটি আমার নাকের সামনে তুলে ধরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি, যেভাবেই হোক একজন খ্রিস্টান। তিনি যেন তোমার পাপ মার্জনা করেন সেজন্যে আমি তাঁর কাছে প্রার্থনা করছি। মাই পুওর ইয়ংম্যান, তোমাদের জন্যেই যে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন তা কীভাবে অবিশ্বাস করছ?’
খেয়াল করলাম তিনি যখন ‘মাই পুওর ইয়ংম্যান’ বললেন তখন বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই বললেন। কিন্তু আমার জন্যে এসবই যথেষ্ট ছিল। আর ঘরটাও ক্রমশ আরও উষ্ণ হয়ে উঠছিল।
সাধারণত কারও কথাবার্তা যখন আমাকে বিরক্ত করে তোলে তখন রেহাই পাবার জন্যে যা করি, এক্ষেত্রেও তা করলাম–অর্থাৎ মেনে নেয়ার ভান করলাম। আশ্চর্য হয়ে গেলাম যখন দেখলাম এতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘দ্যাখো! দ্যাখো! তুমিও কি এখন তাকে বিশ্বাস করছ না বা তার ওপর। তোমার বিশ্বাস রাখছ না?’
আমি বোধহয় মাথা নেড়েছিলাম, কারণ দেখলাম হতাশ হয়ে তিনি আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন।
কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নামল। আমরা যতক্ষণ কথা বলছিলাম টাইপরাইটারটা ততক্ষণ শব্দ করছিল, এবার নীরবতার মধ্যে শেষ মন্তব্যটুকু টাইপ করল। তারপর দেখলাম তিনি সরাসরি খানিকটা দুঃখীভাব নিয়ে তাকালেন আমার দিকে।
‘আমার এতদিনের অভিজ্ঞতায় এর আগে তোমার মতো এত শক্ত লোক আর পাইনি।‘ নিচুগলায় বললেন তিনি, ‘এতদিন যেসব অপরাধী আমার সামনে এসেছে তারা প্রভুর ত্যাগের প্রতীক দেখে কেঁদেছে।’
আমি প্রায় বলে ফেলেছিলাম যে এর কারণ তারা অপরাধী। পরে অনুধাবন। করলাম যে আমি নিজেও ঐ শ্রেণীভুক্ত। এই একটি চিন্তার সঙ্গে কিছুতেই আমার সমঝোতা হচ্ছিল না।
সাক্ষাৎকার শেষ হয়ে গেছে, যেন একথা বোঝাবার জন্যে ম্যাজিস্ট্রেট উঠলেন। সেই একই রকম বিষণ্ণস্বরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন : যা করেছি তার জন্যে কি আমি অনুতপ্ত?
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বললাম, আমি যা অনুভব করছি তা দুঃখ নয় বরং একধরনের বিরক্তি। এর জন্যে ভালো প্রতিশব্দ খুঁজে পেলাম না। কিন্তু মনে হল না যে কথাটা তিনি বুঝেছেন। ঐদিন সাক্ষাৎকারে এসবই ঘটেছিল।
এরপর আমি অনেকবার তার মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু প্রতিবারই আমার উকিল আমার সঙ্গে ছিলেন। প্রশ্নোত্তর সীমাবদ্ধ ছিল আমার পূর্বোক্ত স্বীকারোক্তির মধ্যে। ম্যাজিস্ট্রেট এবং আমার উকিল টেকনিক্যালিটি নিয়ে আলাপ করতেন। ঐসময় তারা আমার দিকে খুব কমই নজর দিতেন।
যাহোক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের ধরনও বদলাতে লাগল। ম্যাজিস্ট্রেট আমার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং আমার মামলার ব্যাপারেও একধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঈশ্বরের প্রসঙ্গ আর তিনি কখনও তোলেননি বা ধর্মীয় কোনো প্রতীকও আমাকে দেখাননি যা প্রথম সাক্ষাৎকারে আমাকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছিল। এর ফলে আমাদের সম্পর্ক আরও সুন্দর হয়ে উঠল। আমার মামলা নিজ পথেই এগোচ্ছে, এভাবে বলতেন তিনি। দু-একটি প্রশ্নের পর আমার উকিলের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করে তিনি আমার প্রশ্নোত্তরে ইতি টানতেন। মাঝে মাঝে সাধারণ কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ চলত, তখন ম্যাজিস্ট্রেট ও উকিল আমাকে আলোচনায় যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। এতে আমি আরও সহজ হয়ে গেলাম। তাদের দুজনের কেউই ঐসময় আমার সঙ্গে প্রতিকূল কোনো আচরণ করেননি। সবকিছু এত মসৃণভাবে, এত প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে চলতে লাগল যে মাঝে মাঝে এক অবাস্তব ধারণা জন্মাত যে আমরা। সবাই একই পরিবারের সদস্য। সত্যি বলতে কি, প্রশ্নোত্তরের এই এগারো মাস। তাদের সঙ্গে আমি এতই একাত্মতা অনুভব করতাম যে মাঝে মাঝে তখন ভেবে অবাক হতাম, এর আগে এরচেয়ে দুর্লভ মুহূর্ত আর আমার জীবনে আসেনি। যখন ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের দোর পর্যন্ত আমার সঙ্গে আসতেন, তখন আমার কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে বন্ধুভাবে বলতেন : ‘তা হলে, জনাব যিশু-বিরোধী, আজকের মতো এখানেই শেষ!’ এরপর আমাকে ওয়ার্ডারদের হাতে সমর্পণ করা হত।