কিছুক্ষণ পর বেশ বিরক্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন। আমি চেয়েছিলাম তিনি আরো কিছুক্ষণ থাকুন। তা হলে হয়তো আমি তাকে বোঝাতে পারতাম যে আমি তার সহানুভূতি চাই, এজন্যে নয় যে আমার পক্ষসমর্থন জোরদার হোক, বরং এভাবে বলা চলে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাকে আমি অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছি এবং তিনি আমাকে প্রতিরোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। স্বভাবতই ব্যাপারটা তাকে বিরক্ত করছিল। দুএকবার ভেবেছিলাম তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করি যে আমিও অন্যদের মতো সাধারণ একটি লোক। কিন্তু তাতে কোনো ফল হত বলে মন হয় না। সুতরাং খানিকটা আলস্য বা এ-ধরনের একটা ভাবের জন্যে আমি কিছু বলিনি।
ঐদিনই, পরে আমাকে আবার পরীক্ষাকারী বিচারকের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। বেলা তখন দুটো এবং এবার ঘরটি আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছিল–জানলায় ছিল একটা পাতলা পরদা –সুতরাং ঘরটি হয়ে উঠেছিল বেশ গরম।
আমাকে বসতে অনুরোধ করে বিচারক অত্যন্ত নরম গলায় বললেন ‘অনিবার্য কারণবশত’ আমার উকিল উপস্থিত হতে পারেননি। আমার অধিকার আছে, তিনি যোগ করলেন, উকিল না-পৌঁছা পর্যন্ত তার প্রশ্নের উত্তর না-দেয়ার।
উত্তরে জানালাম, নিজের হয়ে আমি উত্তর দিতে পারব। টেবিলের ওপর রাখা ঘণ্টাটি তিনি বাজালেন এবং তরুণ একজন কেরানি এসে ঠিক আমার পিছে বসল। তারপর আমরা–আমি এবং বিচারক চেয়ারে আরাম করে বসলাম এবং প্রশ্ন শুরু হল। তিনি এবারে শুরু করলেন যে, স্বল্পভাষী এবং আত্মকেন্দ্রিক লোক হিসেবে আমার একটা খ্যাতি আছে, সুতরাং তিনি জানতে চান এ-ব্যাপারে আমার উত্তর কী হবে। বললাম :
‘মানে, খুব কম সময়ই আমার কিছু বলার থাকত। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমি চুপ থাকতাম।‘
গতবারের মতোই তিনি হাসলেন এবং উত্তরটা যেন যথাযথ এব্যাপারে একমত হলেন। বললেন, ‘যাহোক, এর তেমন কোনো বা কোনো গুরুত্বই নেই।‘
খানিক নীরবতার পর হঠাৎ তিনি সামনে ঝুঁকে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলে বললেন :
‘আমাকে যা আগ্রহান্বিত করছে তা হল–তুমি!’
তিনি কী বলতে চাইছেন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তাই কোনো মন্তব্য করলাম না।
‘তোমার অপরাধের ব্যাপারে তিনি বলে যেতে লাগলেন, কয়েকটি জিনিস আমাকে অবাক করছে। আমি নিশ্চিত যে এগুলি বোঝার ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করবে।’
উত্তরে যখন জানালাম যে ব্যাপারটা অত্যন্ত সোজা তখন তিনি আমাকে ঐদিনের একটি বিবরণ দিতে বললেন। যেদিন আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল সেদিনই সংক্ষিপ্তভাবে–রেমন্ড, সমুদ্রতীর, আমাদের সাঁতার কাটা, তারপর আবার সমুদ্রতীর এবং আমার পাঁচবার গুলি ছোঁড়া সম্পর্কে সব বলেছিলাম। কিন্তু আবার আমি সবকিছু বললাম এবং প্রতিটি কথার শেষে তিনি মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন, ‘বেশ, বেশ’। যখন আমি বালিতে শায়িত দেহটির বিবরণ দিলাম তখন। তিনি আরও জোরে মাথা নেড়ে বললেন, ভালো। ব্যক্তিগতভাবে একই ঘটনার বিবরণ আবার দিতে গিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিল এত কথা জীবনে আর কখনও বলিনি।
আরও কিছুক্ষণ নীরবতার পর তিনি উঠে দাঁড়ালেন, এবং বললেন, তিনি আমাকে সাহায্য করতে চান, আমি তাকে কৌতূহলী করে তুলেছি, ঈশ্বরের কৃপায়। আমার এই বিপদে তিনি কিছু সাহায্য করবেন। কিন্তু তার আগে তার আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
সোজাসুজি তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি আমার মাকে ভালোবাসতাম কি না।
‘হ্যাঁ’, উত্তর দিলাম, অন্যান্য সবার মতো। পিছনে যে-কেরানি বসেছিল, এতক্ষণ সে মসৃণভাবে টাইপ করে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হল সে ভুল অক্ষরে টিপ দিয়েছে কারণ সে তখন তার যন্ত্রটি ঠিক করে ভুল-অক্ষরটি মুছে ফেলছিল।
এরপর আপাতসম্পর্কহীন আরেকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি।
‘কেন তুমি পরপর পাঁচবার গুলি করেছিলে?’
কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম; তারপর বললাম, পরপর গুলিগুলো ছোঁড়া হয়নি। প্রথমে একবার গুলি ছুঁড়েছি এবং খানিক পর বাকি চারটি।
‘প্রথম এবং দ্বিতীয়বারের মাঝে থেমেছিলে কেন?’
সবকিছু যেন আবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তীরের রক্তিম আভা, গালের ওপর সেই উষ্ণ তাপের ভাগ–এবং, এবার আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
এরপর যে-নীরবতাটুকু নামল, ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোক ঐ সময় অস্থিরভাবে চুলের ভিতর আঙুল চালাতে লাগলেন। একবার অর্ধেক উঠে আবার বসে পড়লেন। অবশেষে টেবিলে কনুই রেখে একটু ঝুঁকে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কিন্তু কেন, কেন তুমি বালিতে পড়ে-থাকা একটি লোককে আবার গুলি করেছিলে?’
এবারও আমি কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না।
ম্যাজিস্ট্রেট কপালে একবার হাত বুলোলেন তারপর একটু ভিন্ন সুরে জিজ্ঞেস করলেন :
‘আমি জিজ্ঞেস করছি “কেন”? আমি এই উত্তরের জন্যে তোমাকে জোর করছি।’
তবুও আমি চুপ করে রইলাম।
হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ালেন। উলটোদিকের দেয়াল ঘেঁষে যে ফাইল-ক্যাবিনেট ছিল সেখানে গিয়ে ড্রয়ার খুলে একটি রুপোর ক্রুশ বের করলেন। তারপর ক্রুশটি দোলাতে দোলাতে ডেস্কের কাছে ফিরে এলেন।
‘তুমি জানো ইনি কে?’ তাঁর গলার স্বর তখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আবেগে কাঁপছে তা।
‘নিশ্চয় জানি।‘ উত্তর দিলাম আমি।
এবার যেন তার মুখ খুলে গেল। দ্রুত তিনি কথা বলে যেতে লাগলেন। বললেন, ঈশ্বরে তিনি বিশ্বাসী এবং জঘন্য পাপীরাও ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমতা পেতে পারে। কিন্তু তার আগে এর জন্যে তাকে অনুতপ্ত হতে হবে এবং শিশুর মতো সরল ও বিশ্বাসী হয়ে যেতে হবে যাতে হৃদয় বিশ্বাসের জন্যে থাকে উন্মুক্ত। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমার চোখের সামনে কুশটি তিনি দোলাতে লাগলেন।