গ্রেফতারের পর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তার সবই ছিল আনুষ্ঠানিক প্রশ্ন, আমার পরিচয় ইত্যাদি সম্পর্কে। এর আগে থানায় এ-মামলা নিয়ে কেউ তেমন আগ্রহ দেখায়নি। যাক, এক সপ্তাহ পর যখন আমাকে বিচারকের সামনে হাজির করা হল তখন দেখলাম তিনি বেশ একটা আলাদা কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে আমায় নিরীক্ষণ করছেন। অন্যান্য সবার মতো তিনিও আমার নাম, ঠিকানা, পেশা, জন্মতারিখ এবং জন্মস্থান দিয়ে শুরু করলেন। তারপর তিনি জানতে চাইলেন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে আমি কোনো উকিল নিয়োগ করেছি কি না। উত্তরে বললাম, ‘না’, এ বিষয়ে আমি কোনো চিন্তাই করিনি; এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম সত্যিই একজন উকিল নিয়োগ করার দরকার কি না। ‘তুমি এ প্রশ্ন করছ কেন?’ উত্তরে বললেন তিনি। বললাম, ‘মামলাটা আমার কাছে খুব সরল বলে মনে হয়েছে। তিনি হাসলেন। তা তোমার কাছে সরল বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের তো আইন মেনে চলতে হয়। তুমি যদি নিজের জন্যে উকিল ঠিক না করো তবে আদালতকেই তোমার জন্যে উকিল ঠিক করতে হবে।’
কর্তৃপক্ষ যে এত খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে নজর রাখেন তা দেখে আমি চমৎকৃত হলাম এবং তাঁকে তা জানালাম। তিনি মাথা নাড়লেন এবং মেনে নিলেন যে আইন হচ্ছে সবকিছু যা আকাক্ষা করা যায়।
প্রথমদিকে আমি তাঁকে তেমন গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেনি। যে-ঘরে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন তা ছিল সাধারণ বৈঠকখানার মতো। জানালায় পরদা, টেবিলে একটি বাতি। বাতির আলোটা পড়ছিল আরামকেদারার ওপর যেখানে তিনি আমাকে বসিয়েছিলেন আর তাঁর নিজের মুখ ছিল অন্ধকারে।
বইয়ে আমি এ-ধরনের দৃশ্যের বর্ণনা পড়েছি, এবং প্রথমে এ সবকিছু আমার কাছে খেলার মতো মনে হল। আমাদের কথোপকথন শেষ হলে আমি তার দিকে ভালো করে নজর দিলাম।
পরদিন আমার সেলে এলেন ছোটখাটো হৃষ্টপুষ্ট কালোচুলো কমবয়েসি এক উকিল। গরম থাকা সত্ত্বেও আমি পুরোহাতা শার্ট পরেছিলাম আর তার পরনে ছিল গাঢ় রঙের সুট, শক্ত কলার, চওড়া শাদা-কালো স্ট্রাইপের বাহারি টাই। অ্যাটাচি কেসটা আমার বিছানায় রেখে তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার মামলার নথিপত্র উনি খুব সাবধানে দেখবেন। তাঁর মতে, ঐভাবে দেখা প্রয়োজনীয় এবং আমি যদি তাঁর উপদেশমতো চলি তবে ছাড়া পাওয়ার পুরোমাত্রায় আশা আছে। ধন্যবাদ জানালাম তাকে এবং তিনি বললেন, বেশ, এবার বসা যাক।
বিছানায় বসে তিনি বললেন, তারা আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তথ্য সন্ধান করছিলেন। তারা জেনেছেন, সম্প্রতি আমার মা মারা গেছেন আশ্রমে। মারেনগোতে তদন্ত হয়েছে এবং পুলিশ জানিয়েছে মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমি ‘ভীষণ উদাসীনতা’ দেখিয়েছি।
‘তোমার বোঝা দরকার’, বললেন উকিল ভদ্রলোক, ‘ঐ ব্যাপারে প্রশ্ন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু এর গুরুত্ব আছে এবং উদাসীনতা–এই অভিযোগের বিরুদ্ধে যদি আমি যুক্তি খাড়া করতে না পারি তা হলে তোমার পক্ষ সমর্থন করা মুশকিল হয়ে পড়বে। এবং এ-বিষয়ে তুমি, একমাত্র তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পারো।‘
তিনি জিজ্ঞেস করলেন ঐ ‘দুঃখজনক ঘটনায়’ আমি শোকাভিভূত হয়েছিলাম কি না। প্রশ্নটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকল। ব্যক্তিগতভাবে অন্য কাউকে যদি আমায় এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হত তা হলে আমি আরও বেশি অপ্রস্তুত হতাম।
উত্তরে আমি জানালাম সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নিজের অনুভূতির দিকে নজর রাখার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে এবং সেজন্যে আমি কী উত্তর দেব জানি না। সত্যি করে বলতে গেলে বলব মা’র আমি বেশ ভক্ত ছিলাম। কিন্তু তার মানে খুব বেশি নয়; সব স্বাভাবিক লোক, যোগ করলাম, কোনো-না-কোনো সময় তাদের প্রিয়জনদের মৃত্যুর কথা কমবেশি চিন্তা করে।
এখানে আমার উকিল বাধা দিলেন। তাঁকে ভীষণ বিচলিত মনে হচ্ছিল।
‘তোমাকে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হবে আদালতে বা বিচারককে তুমি এ-ধরনের কোনো কথা বলবে না।‘
তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্যে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমার শারীরিক অবস্থা আমার চিন্তাভাবনার ওপর প্রায়ই প্রভাব বিস্তার করে। যেমন, মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যেদিন যোগ দিয়েছিলাম সেদিন এতই ক্লান্ত ছিলাম যে আমি আধোঘুমে ছিলাম। সুতরাং ঐ সময় কী কী ঘটেছে তার অনেককিছুই আমি জানি না। তবে তাকে একটি ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারি : মা’র মৃত্যু হোক তা আমি চাইনি।
ভদ্রলোক সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হল না। সংক্ষিপ্তভাবে তিনি বললেন, এটা যথেষ্ট নয়।’
ব্যাপারটা একটু চিন্তা করার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ঐদিন আমি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম, একথাটা তিনি বলতে পারেন কি না।
‘না’, বললাম আমি, কথাটা সত্যি হবে না।’
একটু অবাক হয়ে তিনি তাকালেন আমার দিকে যেন আমি তার প্রতি খানিকটা বিতৃষ্ণ। তারপর প্রায় শত্রুতাপূর্ণ গলায় জানালেন, তা হলে আশ্রমের প্রধান এবং সেখানকার কয়েকজন কর্মচারীকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হবে।
‘এবং তুমি বিপদে পড়বে।’ কথা শেষ করলেন তিনি।
আমি বললাম, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সঙ্গে মার মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। তখন তিনি উত্তর দিলেন, এই ধরনের মন্তব্যে বোঝা যায় আইনের মুখোমুখি আমি কোনোদিন হইনি।