বাংলোয় যখন পৌঁছলাম তখন রেমন্ড দ্রুতগতিতে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল উপরে, কিন্তু আমি বসে পড়লাম নিচের সিঁড়িতেই। মনে হচ্ছিল, রোদ আমার মাথায় বাড়ি মারছে এবং সেই উপরে উঠে মহিলাদের কাছে নিজেকে অমায়িক করে তোলাটা মনে হচ্ছিল কেমন যেন দুঃসাধ্য। কিন্তু রোদ এত কড়া যে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে দাঁড়ানোটাও ছিল কষ্টসাধ্য। আকাশ থেকে ঝরে-পড়া এই অন্ধ-করা আলোর বন্যার নিচে থাকা বা বাইরে যাওয়া–একই কথা। কয়েক মুহূর্ত পর আমি সৈকতে ফিরে হাঁটা শুরু করলাম।
যতদূর চোখ যায় ততদূর সেই লাল ঝকঝকে আলো এবং ছোট ছোট ঢেউগুলি খানিক পরপর গড়াগড়ি খাচ্ছে গরম বালিতে। সৈকতের শেষমাথায় সেই পাথরগুলির কাছে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল কড়া রোদের জন্যে আমার কপালের দুপাশের শিরা যেন ফুলে উঠছে। এটা আমাকে চেপে ধরে যেন আমার গতি রুদ্ধ করতে চাচ্ছে। এবং যখনই গরম বাতাসের ঝাঁপটা আমাকে বাড়ি মারছিল তখনই আমি দাঁতে দাঁত চেপে, পকেটে হাত মুঠি করে, প্রত্যেকটি স্নায়ুকে তৈরি রাখছিলাম সূর্য এবং যে অন্ধ-করা আলো আমার ওপর ঝরছে তাকে প্রতিহত করতে। যখনই বালিতে পড়ে-থাকা ঝিনুক বা ভাঙা কাঁচে আলো পড়ে ঝলক উঠছিল তখনই আমার চোয়াল হয়ে উঠছিল কঠিন। নিজেকে আমি কাবু হতে দিচ্ছি না। দৃঢ়ভাবে আমি হেঁটে যেতে লাগলাম।
সেই কালো ছোট কুঁজের মতো টিলাটা সৈকতের দূরে দেখা যাচ্ছে। ঝকঝকে আলোর বৃত্ত তার চারদিকে, কিন্তু আমি ভাবছিলাম এর পিছনের সেই ঠাণ্ডা পরিচ্ছন্ন ঝরনাটার কথা আর উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছিলাম বহতা পানির সেই মৃদু কলতান শোনার জন্যে। এই আলোর তীব্রতা কান্না-পাওয়া মহিলা, ক্লান্তি সবকিছু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে সেই টিলার ছায়ায়, ঝরনা আর তার শীতল নৈঃশব্দে।
কিন্তু যখন কাছে পৌঁছলাম তখন দেখি রেমন্ডের সেই আরব ফিরে এসেছে। সে তখন একলা, চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হাতদুটি মাথার পেছনে, মুখটা টিলার ছায়ায়। বাকি শরীর কড়া রোদে। তার কাপড় মনে হচ্ছিল যেন সূর্যের আলোয় সিদ্ধ হচ্ছে। একটু আশ্চর্য হলাম। আমি ভেবেছিলাম, ঘটনাটার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এবং এখানে আসার পথে এ-ব্যাপারটার কথা আমার একবারও মনে হয়নি।
আমাকে দেখে আরবটি একটু উঁচু হল এবং হাত ঢোকাল পকেটে। স্বভাবতই পকেটে রেমন্ডের রিভলবারটা চেপে ধরলাম। তারপর আরবটা আবার শুয়ে পড়ল, হাত কিন্তু পকেটেই থাকল। আমি ছিলাম খানিকটা দূরে, দশ গজ হবে, এবং বেশির ভাগ সময়ই তাকে কালো এক টলটলায়মান বস্তুর মতো মনে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে আবার নজরে পড়ছিল আধবোজা পাতার নিচের জলন্ত চোখদুটো। ঢেউয়ের শব্দগুলিকে মনে হচ্ছিল দুপুর থেকেও মদালসা এবং নমিত। রোদ কিন্তু কমেনি; তা তখনও সেই টিলা পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকতকে ঝলসাছিল। দু-ঘণ্টায়ও সূর্যের কোনো হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না, যেন নিথর গলানো। ইস্পাতের সমুদ্র। লোকটার দিকে নজর রাখছিলাম এবং দূর দিগন্তে যে একটি স্টিমার যাচ্ছিল, আড়চোখে সেই চলন্ত কালো বিন্দুটাকে দেখছিলাম।
হঠাৎ মনে হল আমার এখন যা করা দরকার তা হল পিছু ফিরে চলে যাওয়া এবং এ ঘটনার কথা না-ভাবা। কিন্তু পুরো সৈকতটা যেন তাপে টগবগ করে পিছন থেকে আমাকে চেপে ধরছে। ঝরনার দিকে এগিয়ে গেলাম কয়েক পা। নড়ল না আরবটা। তখনও আমাদের মধ্যে দূরত্ব আছে খানিকটা। তার মুখের ওপর ছায়া। পড়ার জন্যে মনে হচ্ছিল সে যেন ভেংচি কাটছে আমার দিকে তাকিয়ে।
অপেক্ষা করছিলাম। উত্তাপে আমার গাল যেন ঝলসাচ্ছিল, ঘামের ফোঁটা জমছিল ভুরুতে। মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন ছিল যেরকম রোদ, এখনও রোদ ঠিক সেরকম এবং আমার মনে ঠিক সেরকম একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি জাগছিল, বিশেষ করে কপালে, সেখানে মনে হছিল প্রত্যেকটি শিরা যেন চামড়া ফেটে বেরুবে। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, এগিয়ে গেলাম আরেক পা। জানতাম বোকামি হচ্ছে কাজটা; দুএক পা এগিয়ে গেলেই তো আর সূর্যের আড়াল হব না। তবুও এক পা এগোলাম সামনে, ঠিক এক পা। আর তখুনি আরবটা ছুরি বের করে সামনে ধরল।
ইস্পাত থেকে একঝলক আলোর রশ্মি লাফিয়ে উঠল আর আমার মনে হল, যেন লম্বা একটি পাতলা ব্লেড স্থির হয়ে আছে আমার কপালে। সে-সঙ্গে আরও মনে হল চোখের ভুরুতে যত ঘাম জমেছিল সেসব চোখ বেয়ে ঝরছে। পানি ও ঘামের পরদার নিচে চাপা পড়ে গেছে দুই চোখ। সূর্য যে আমার করোটিতে দামামা বাজাচ্ছে সে-সম্পর্কে আমি সচেতন, কেবল ঝাঁপসা লাগছে ছুরি থেকে উৎক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ সেই আলোর রশ্মি, যেন তা ভুরু ফেড়ে গেঁথে যাচ্ছে চোখের মণিতে। তারপর সবকিছুই ঘুরতে শুরু করল আমার চোখের সামনে। সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এল আগুনের হলকা আর আকাশটা দিগন্ত থেকে দিগন্তে যেন হয়ে গেল দু-টুকরো। আর সেই গহ্বরে ঝরতে লাগল আগুনের শিখা। আমার শরীরের প্রতিটি তন্তু যেন ইস্পাতের মতো তীক্ষ্ণ আর তীব্র, রিভলবারের ওপর আমার মুঠি দৃঢ় হয়ে এল। ট্রিগার টিপলাম আর মসৃণ একটা ধাক্কা এসে স্পর্শ করল করতল। ঐ শব্দ থেকেই শুরু। আমি ঝেড়ে ফেললাম ঘাম আর আলোর পরদা। আমি। জানি, দিনের এই নিটোলতা আর সমুদ্রতীরের এই বিশাল প্রশান্তি আমি ফেলেছি ছিঁড়েখুঁড়ে যেখানে ছিল আমার সুখ। ঐ নিস্পন্দ শরীরে আমি আরও চারবার গুলি করলাম। আর প্রতিটি গুলি ছিল আমার নিয়তির দিকে সোচ্চার আওয়াজ।
২. দ্বিতীয় পর্ব – গ্রেফতারের পর
১.