আশ্রমটি গ্রাম থেকে মাইলখানেকের কিছু বেশি দূরে। হেঁটেই চলে গেলাম সেখানে। পৌঁছেই ঠিক তখন-তখনই আমি মাকে দেখতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু দারোয়ান জানাল, প্রথমে আমাকে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওয়ার্ডেন তখন ব্যস্ত, সুতরাং আমাকে অপেক্ষা করতে হবে খানিকটা। দারোয়ান এ সময়টুকু আমার সঙ্গে কথা বলে কাটাল, তারপর নিয়ে গেল অফিসে। ওয়ার্ডেন মানুষটি ছোটখাটো, মাথার চুল ধূসর আর বাটন-হোলে লাগানো লিজিয়ন অফ অনারের গোলাপ। তিনি তাঁর টলটলে নীল চোখ মেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর আমরা হাত মেলালাম এবং এত দীর্ঘক্ষণ তিনি। আমার হাত ধরে রাখলেন যে রীতিমতো অস্বস্তি লাগছিল। তারপর এক অফিস রেজিস্টার বের করে আমার সামনে রেখে বললেন :
‘মাদাম মারসো এ-আশ্রমে ভরতি হয়েছিলেন তিন বছর আগে। তার নিজের কোনো সামর্থ্য ছিল না এবং সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তিনি তোমার ওপর।‘
আমার মনে হল, তিনি বোধহয় আমাকে কোনোকিছুর জন্যে দোষ দিতে চাচ্ছেন, সুতরাং কৈফিয়ত দেয়া শুরু করলাম। কিন্তু আমাকে তিনি থামিয়ে দিলেন, “তোমায় কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না হে! আমি পুরো কাগজপত্র দেখেছি, তোমার এমন কোনো ভালো অবস্থা ছিল না যে তুমি তোমার মা’র যত্ন নিতে পারো ভালোভাবে। সবসময় দেখাশোনার জন্যে তাঁর একজনের দরকার ছিল। আর তোমরা ছেলে-ছোকরারা যা চাকরি করো তাতে মনে হয় না তো খুব একটা রোজগার করো। যাহোক তোমার মা এখানে বেশ সুখী ছিলেন।
‘জি স্যার, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।’ বললাম আমি। তারপর তিনি যোগ করলেন : ‘এখানে তাঁর ভালো কিছু বন্ধু ছিল, তার মতোই বৃদ্ধ সব। আর বোধহয় জানো, সবাই নিজ নিজ জেনারেশনের লোকদেরই পছন্দ করে বেশি। বয়স তোমার কম সুতরাং তুমি তার খুব ভালো সঙ্গী হতে পারতে না।’
কথাটা আসলে ঠিক। যখন আমরা একসঙ্গে থাকতাম তখন মা সবসময় আমাকে নজরে রাখতেন ঠিকই তবে ক্বচিৎ আমরা কথা বলতাম। আশ্রমে প্রথম কয়েক সপ্তাহ তিনি বেশ কান্নাকাটি করেছিলেন, কারণ আশ্রমে তখনও তিনি অভ্যস্ত হননি। তার একমাস কি দুমাস পর যদি তাকে আশ্রম ত্যাগ করতে বলা হত তা হলে বোধহয় তিনি কাঁদতেন। তাই গত কয়েক বছর আমি তাকে চিৎ দেখতে যেতাম। কিন্তু তাতেও আমার রোববারটা নষ্ট হত বাস ধরার ঝামেলা, টিকিট করা, আসা-যাওয়ার দু-ঘণ্টার কথা নাহয় বাদই দিলাম।
ওয়ার্ডেন কথা বলে চলছিলেন। কিন্তু কান আমার সেদিকে ছিল না। অবশেষে তিনি বললেন, ‘এখন বোধহয় তুমি তোমার মাকে দেখতে চাও?’
কথা না বলে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার দিকে তিনি আমায় নিয়ে চললেন। কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় তিনি বললেন :
‘মৃতদেহ আপাতত আমি আমাদের ছোট শবাগারে সরিয়ে রেখেছি–বুঝতেই পারছ যাতে অন্যরা উতলা না হয়। এখানে কেউ মারা গেলে দুএকদিন সবাই বড় উদ্বিগ্ন থাকে, যার অর্থ অবশ্যই আমাদের কর্মচারীদের জন্যে বাড়তি কাজ আর ঝামেলা।’
আমরা একটা উঠোন পেরুলাম যেখানে বেশকিছু বৃদ্ধ ছোট ছোট জটলা বেঁধে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আমরা কাছে আসতেই তারা চুপ মেরে গেলেন। তারপর আমাদের পিছে আবার কথা শুরু হল। তাদের কণ্ঠস্বর আমাকে খাঁচায় বন্দি টিয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অবশ্য তাঁদের গলার স্বর তত তীক্ষ্ণ ছিল না। আমরা গিয়ে থামলাম ছোট এক নিচু বাড়ির সামনে।
‘সুতরাং, তোমাকে আমি এখানেই ছেড়ে যাচ্ছি সঁসিয়ে মারসো। কোনোকিছুর দরকার হলে বোলো, অফিসে আছি আমি। আগামীকাল সকালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে আমরা ঠিক করেছি। সুতরাং পুরো রাতটাই তুমি তোমার মার কফিনের পাশে কাটাতে পারবে এবং তোমার ইচ্ছেও বোধহয় তা-ই। হ্যাঁ, ভালো কথা, তোমার মা’র বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তার ইচ্ছে ছিল তাঁকে যেন চার্চের নিয়ম অনুযায়ী কবর দেয়া হয়। আমি অবশ্য এর বন্দোবস্ত করে রেখেছি। তবুও কথাটা তোমাকে জানানো দরকার মনে করলাম।‘
ধন্যবাদ জানালাম তাঁকে। যদুর জানি, আমার মা জীবদ্দশায় নাস্তিক ছিলেন না, তবে ধর্মের প্রতি মনোযোগ দেননি কখনও।
শবাগারে প্রবেশ করলাম। উঁচু স্কাইলাইট দেয়া, চুনকাম করা, পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে এক ঘর। আসবাবপত্রের মধ্যে আছে কয়েকটা চেয়ার আর কাঠের তৈরি কয়েকটা খুঁটি যার ওপর সাময়িকভাবে কিছু রাখা যেতে পারে। এরকম দুটো খুঁটির ওপর কফিনটা রাখা। কফিনের ঢাকনা বসানো কিন্তু আঁটা হয়নি স্ক্র এবং দাগপড়া আখরোট কাঠের ওপর সেগুলির ধাতুর মাথা জেগে আছে। একজন নার্স, বোধহয় কোনো আরব-রমণী, বসেছিল কফিনের পাশে, পরনে তার নীল স্মোক, চুল বাধা এক জমকালো স্কার্ফ দিয়ে।
ঠিক সে-সময় বুড়ো দারোয়ানটা এসে হাজির। বোধহয় দৌড়ে এসেছে, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত।
‘কফিনের ঢাকনা আমরা বন্ধ করে রেখেছি। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে আপনি এলে যেন ঢাকনা খুলে দিই যাতে আপনি তাকে দেখতে পারেন।’ বলে, যখন সে কফিনের দিকে যাচ্ছিল তখন আমি তাকে কষ্ট করতে মানা করলাম।
‘অ্যাঁ, কী?’ একটু অবাক হল সে, ‘আপনি চান না যে আমি ….?’
‘না’, বললাম আমি।
স্ক্রু-ড্রাইভারটা পকেটে রেখে সে তাকাল আমার দিকে। বুঝলাম, আমার ‘না’ বলা উচিত হয়নি এবং ব্যাপারটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলল। কিছুক্ষণ আমাকে নিরীক্ষণ করে সে বলল, ‘কেন, না কেন?’ গলার স্বর তার ক্ষুব্ধ নয়, শুধুমাত্র জানতে চাওয়ার জন্যেই এ-প্রশ্ন।